–আশু পাল–
২০১৬ সালের ১৯ জুলাই কেন্দ্রীয় সরকার ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল- ২০১৬’ লোকসভায় পেশ করে। আইনের সেই খসড়ায় পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে আগত ‘শরণার্থী’ হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ (মুসলমান নয়) মানুষদের কিছু শর্ত সাপেক্ষে স্থায়ী নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মুসলমানদের এই প্রস্তাবিত আইনের আওতায় রাখা হয়নি এই যুক্তিতে যে, ওই তিন দেশেই মুসলমানেরা বিপুল সংখ্যায় রয়েছেন, এবং প্রকৃত অর্থে তিন দেশই ‘ইসলামিক দেশ’ -এ পরিণত হয়েছে। কাজেই মুসলমানেরা সেই স্থান ত্যাগ করবেন কেন, আর করলেও আমরা তাদের নাগরিকত্ব দেব কেন?
তারপর জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি ইত্যাদি দীর্ঘ পরিক্রমা সেরে সেই বিল গতকাল (৮ জানুয়ারি, ২০১৯) লোকসভায় পেশ এবং পাশ হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত আইন হতে এখনো আরো প্রক্রিয়া বাকি। আইন যখন হবে, তখন অবশ্যই তা সারা দেশের জন্যই প্রযোজ্য হবে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, আসামে দীর্ঘ ‘বঙাল খেদা’, ‘বিদেশি বিতাড়ন’ এবং ‘বাংলাদেশি খেদা’ আন্দোলনের পথ বেয়েই এই আইনের কথা ‘কনসিভ’ করেছে বর্তমান কেন্দ্রের সরকার। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন প্রস্তাবিত এই আইনের পক্ষে বিপক্ষে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছে। শুধু মতামত ব্যক্ত করাই নয়, অনেকে প্রত্যক্ষ আন্দোলনেও নেমেছে।
আসামে শাসক জোট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে প্রস্তাবিত আইনের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার পথে হাঁটছে অসম গণ পরিষদ দল। তাছাড়াও অনেকানেক দল ও সংগঠন ইতোমধ্যেই তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়েছে। এমনও প্রচার চলছে যে, এই আইন পাশ হলে বর্তমানেও যে দেড় কোটির মত বাঙালি হিন্দু বাংলাদেশে রয়েছেন, তাদেরও প্রকারান্তরে এই আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্বের আমন্ত্রণ পাঠানো হবে। ফলে মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হবে অসমীয়া জাতি, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। অন্যদিকে বিলের সমর্থকেরা বলছেন, আসামে বসবাসকারী হিন্দু বাঙালিদের জন্য সার্বিক নিরাপত্তা ও পূর্ণ নাগরিকত্বের গ্যারান্টি দেবে এই আইন। ‘ডি’ ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্প, এন আর সি সহ সব রকমের অমানবিক নাগরিক হয়রানির হাত থেকে এই আইন মুক্তির নিশ্চয়তা দেবে।প্রস্তাবিত এই আইনের খসড়া যতটুকু পড়েছি এবং গতকাল লোকসভায় পেশের আগে মাননীয় মন্ত্রী লোকসভায় দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিয়ে যা বলেছেন এবং যা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন, তা থেকে কিছু সংশয় ও সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ‘নেশন্যাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস’ (সংক্ষেপে এন আর সি)র কাজ শুধু আসামেই চলছে। অজস্র ধরণের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান এবং নিত্য-নব নির্দেশিকা ও দাবির বেড়াজাল পেরিয়ে এই কাজ কবে শেষ হবে, কবে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি ও প্রকাশিত হবে বলা দুষ্কর। প্রকাশিত তথ্য মতে, কমবেশি ৪০ লক্ষ “ঘুসপেটিয়া” বা “উইপোকা”র নাম সর্বশেষ তালিকায় ওঠেনি। তাদের ভবিষ্যত নিয়ে কিছু প্রশ্ন মনে জাগছে। আইন বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য বিজ্ঞজনেরা হয়তো এ ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবেন।
ধরে নিচ্ছি একজন ব্যক্তি সপরিবারে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে, বা নির্যাতনের আশঙ্কায় বাংলাদেশ থেকে স্থায়ীভাবে ভারতের আসাম রাজ্যে চলে এসেছেন একাত্তর সালের আগে বা পরে। জীবন ধারণের তাড়নায় দিনরাত ব্যস্ত থাকার ফলে কোনও ধরণের প্রামাণ্য নথি নেই তাদের কাছে। স্বাধীনতার নামে দেশ ভাগের পর দেশের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী নেহরুজি সবাইকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, দু-দেশের এপারে ওপারে যারা রয়ে গেলেন, তাদের কোনো চিন্তা নেই। যদি কোনোদিন তারা ওপার থেকে এপারে বা এপার থেকে ওপারে যেতে চান, তবে তাদের কোনো সমস্যা পোহাতে হবেনা। সাদরেই তাদের গ্রহণ করা হবে। তাই, সেই ধরণের নথি যে যোগাড় করে রাখা দরকার ভবিষ্যতে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য, তা কোনোদিন ভাবেনও নি তারা। তবে সৌভাগ্যক্রমে ‘ডি’ ভোটার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে বা ‘বিদেশি’ ঘোষিত হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়ার নরক যন্ত্রণা থেকে তারা বেঁচে গেছেন। কিন্তু প্রকাশিত সর্বশেষ এন আর সি তালিকায় তাদের নাম ওঠেনি।
সম্প্রতি এন আর সি-র চাপে পড়ে এখানে ওখানে দৌড়ঝাঁপ করে, এর হাতে ওর পায়ে ধরে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকা পয়সা খরচ করে কিছু একটা নথি তারা সংগ্রহ করে পেশ করেছেন এন আর সি কর্তৃপক্ষের কাছে। কর্তাব্যক্তিরা এখনো যাচাই করে বুঝে উঠতে পারেন নি তাদের নাম নাগরিক তালিকায় ওঠানো যায় কিনা। আর আবেদনকারীরা অপেক্ষা করছেন, ইতিবাচক ফলের। ভুয়ো নথি হোক বা ন্যায্য দলিলই হোক, আবেদনকারী কিন্তু দাবি করছেন তিনি ন্যায়সঙ্গত ভারতীয়; নিজেকে বাংলাদেশ থেকে আগত বলে স্বীকার করছেন না।
এই অবস্থায়, ধরে নেওয়া যাক, প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল লোকসভা, রাজ্যসভা, রাষ্ট্রপতির দফতর ঘুরে আইনে পরিণত হলো। সেই হতভাগ্য পরিবার এবার আইনের ধারা অনুযায়ী লিখিত ভাবে আবেদন করলেন নাগরিকত্বের জন্য। উল্লেখ্য যে, প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, আবেদনকারী কবে, কোন ঠিকানা থেকে, কেন স্বভূমি ত্যাগ করে এসেছেন, তার বর্ণনা দিতে হবে। প্রশ্ন উঠবে এখানেই। আবেদনকারী এখানে নিজে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে তিনি একাত্তর সালের পর ভারতে প্রবেশ করেছেন, এবং তার কোনো বৈধ প্রামাণ্য নথি নেই। এন আর সি-র রাজ্য কর্তা প্রতীক হাজেলা কিন্তু আগেই সাবধান করে রেখেছেন, এন আর সি-র আবেদনের সঙ্গে কেউ যদি ভুয়ো দলিল দস্তাবেজ দাখিল করেন, তবে যে শুধু নাগরিক তালিকায় তার নাম উঠবে না তাই নয়, তাকে ভয়ানক আইনি শাস্তির মুখে পড়তে হবে।
দাখিল করা দলিলের পর এখন নিজের লিখিত স্বীকারোক্তি জমা দেওয়ার ফলে এক্ষেত্রে তার কি অবস্থা হবে ? হাজেলা মহোদয় বর্ণিত শাস্তি থেকে রেহাই পাবেন কি না ? লোকসভায় গতকাল মন্ত্রী মহোদয় যা বলেন নি, তা হলো, আইনের ধারা অনুযায়ী আবেদনগুলি দিশপুর, দিল্লি, ঢাকা, নির্দিষ্ট জেলা সদর ঘুরে গিয়ে পৌছাবে আবেদনকারী দ্বারা উল্লেখিত গ্রামে, যে ঠিকানা থেকে তিনি এসেছেন বলে ঘোষনা করেছেন। সেদেশের সেই গ্রামের সরকারি আধিকারিক তাদের কার্যালয়ে সংরক্ষিত পুরোনো দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে (যদি আদৌ সেগুলি যথাযথ ভাবে সংরক্ষিত থাকে) জানাবেন যে সেই নামে সেই গ্রামে কোনো ব্যক্তি বা পরিবার একসময় বাস করতেন কি না। সেই সঙ্গে তিনি এটাও জানাবেন যে ওই পরিবার তখন সত্যি সত্যিই ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে বা আশঙ্কায় দেশত্যাগী হয়েছিলেন, নাকি উন্নততর জীবনযাপনের স্বপ্নে সেই গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। কোনও দেশের একজন নাগরিক ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে বা আশঙ্কায় দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন, সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল — কোনো সার্বভৌম দেশের সরকার তাদের এই ব্যর্থতা লিখিত ভাবে স্বীকার করে নেবে, এটা আশা করা কি খুব বাস্তবজ্ঞানের পরিচায়ক ? তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম, সেটাও হলো।
শাসক দল যতই আশ্বাস দিক, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা যে দল-মত নির্বিশেষে এই বিলের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিরোধী আন্দোলনের দিকে এগোচ্ছে, তা কারো অজানা নয়। অগপ, কৃষক মুক্তি, হীরেন গোঁহাই থেকে শুরু করে কখনো ৬২ সংগঠন, কখনো আরো বেশি সংগঠনের নামে ধারাবাহিক আন্দোলনের সূচনা হয়েই গেছে। সেই আন্দোলনকে প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে ছড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টাও জোরকদমে চলছে। জন সাধারণ সার্বিকভাবে আন্দোলনমুখী হয়ে উঠলে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। ভোট বড় বালাই। তাছাড়া এই আইনের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দরজায় হাজির হয়েই আছেন অনেকে। কারণ এই প্রস্তাবিত আইন স্পষ্টতই দেশের সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারাকে লঙঘন করছে – যেখানে বলা হয়েছে, এ দেশে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিক অধিকার দেওয়া যাবেনা। সব ধর্মাবলম্বী মানুষের সম-অধিকার সুনিশ্চিত থাকবে। তাই সুপ্রিম কোর্টে এই আইন বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না। ১৯৮৩ সালে ইন্দিরা সরকারের আমলে পাশ হওয়া আই এম ডি টি আইন, যা কিনা ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল, ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টে মোকদ্দমা করে এভাবেই সেটা বাতিল করে দিয়েছিলেন আজকের আসামের মুখ্যমন্ত্রী, সেদিনের আসু নেতা সর্বানন্দ সোনোয়াল।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার আন্দোলনের চাপে সরকার যদি এই আইন বাস্তবায়ন থেকে পিছিয়ে আসে, অথবা এই আইন যদি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাতিলও হয়ে যায়, আবেদনকারীদের লিখিত স্বীকারোক্তি কিন্তু সরকারের কাছে থেকেই গেল। যারা নিজেরাই স্বীকার করে নিয়েছে যে তারা বাংলাদেশ থেকে ১৯৭১ সালের পরে ভারতের আসামে এসেছে, তাদের এবার কি ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, কেউ ভেবে দেখেছেন কি ?
আশুদা খুব ভাল বিশ্লষণ করলেন, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সঙ্গে ওয়েব পেজ “উয়েটুবরাক”কেও ধন্যবাদ।
Thanks Dada for your positive comment….Team way2barak