AnalyticsBreaking News

কা, কা-কা এবং কাকাতুয়া (পর্ব – ২), লিখেছেন সুব্রত দাস

৬ জানুয়ারি: স্ববিরোধিতাপূর্ণ সিলেকটিভ মতামত সহ আজকাল নাগরিকত্ব আইন নিয়ে শিক্ষক, অধ্যাপক, শিল্পী, কলাকুশলী, পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অনেকেই রাজনীতির আঙিনায় মিথ্যার বেসাতি নিয়ে হাজির। ভারতীয় সংবিধান বাকস্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে বলেই মানুষের ট্রেন, বাস, সরকারি সম্পত্তি জ্বালিয়ে ভেঙে তছনছ করাকে গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক অধিকার বলে তো আর মেনে নেওয়া যায় না। যদি ভারত আমাদের দেশ, ভারত আমাদের মাটি, ভারত আমাদের মা হয়, তাহলে এই দেশ, মাটি এবং মায়ের নিরাপত্তা, রক্ষার জন্য আমাদের সবসময় সচেষ্ট থাকা উচিত।

অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব আজকাল নাগরিকত্ব আইন নিয়ে এখন স্পষ্ট মিথ্যাচার করছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ‘কা’ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপর্ণা সেনের মতো বিখ্যাত অভিনেত্রী এবং চলচ্চিত্র নির্দেশক সম্প্রতি তাঁর ট্যুইটে বলেছেন, আমাদের Subcontinent বা উপ-মহাদেশ নাকি ধর্মনিরপেক্ষতার চিকন সুতোয় বাঁধা, যেটা ছিঁড়ে বা নষ্ট হয়ে গেলে এই দেশ ভেঙে যাবে! পাশের তিন তিনটে দেশ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান কি উপমহাদেশের মধ্যে পড়ে, নাকি পড়ে না? এই তিনটি দেশ কি ধর্মনিরপেক্ষ, নাকি Theosophical Islamic State বা ধর্মীয় ইসলামিক রাষ্ট্র? নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন কেন প্রয়োজন পড়ল ভারতের? ভারত কি ভেঙে টুকরো হয়নি আগে? কে বা কারা দায়ী ছিল এজন্য? টুকরো হবার পর সৃষ্ট এই দেশগুলো যদি ধর্মনিরপেক্ষ হতো, তাহলে এই ‘কা’ আইনের দরকার হতো কি?

অনেকেই জানেন না যে, আমাদের দেশে কোনও মানুষ নিম্নোক্ত পাঁচটি পথে নাগরিকত্ব পেতে পারে। By birth (যিনি এদেশে জন্মেছেন), by descent (যার পিতা-মাতার নাগরিকত্ব আছে), by registration (বিবাহ ইত্যাদি সূত্রে যিনি রেজিষ্ট্রেশন বা পঞ্জীয়ন করবেন), by naturalization (যিনি ভারতের নাগরিক না হয়েও অনেক বছর ধরে ভারতে রয়েছেন) এবং by accession (অন্য দেশের কোনও স্থান সরকার চুক্তি মারফত বিনিময় বা অধিগ্রহণ করার পর ওই স্থানে সেসব মানুষ বসবাস করে আসছেন)। এরা সবাই ভারতীয় নাগরিকত্বের দাবিদার।

এরমধ্যে বাকি সবগুলো যেমন ছিল তেমনি আছে, শুধু ন্যাচারেলাইজেশনের ক্ষেত্রে আগে সমস্ত মানুষের জন্য ওয়েটিং পিরিয়ড ছিল ১২ বছর, যা সিএএ বা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে উপরোক্ত তিনটি দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় প্রতারণার জন্য ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে পালিয়ে আসা  হিন্দু, খৃষ্টান, শিখ, বৌদ্ধ, পার্সি এবং জৈন– ছ’টি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর অসহায় মানুষের ক্ষেত্রে এ দেশে নাগরিকত্ব লাভের জন্য পাঁচ বছর করা হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, এই নিয়মে এখন আর কোনও আফগানিস্তান, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিম মানুষ আবেদন করতে পারবেন না। এই ক্লজে কিছু আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মানুষ ইতিমধ্যে আবেদন করে ভারতের নাগরিকত্বও পেয়েছেন। সবচেয়ে বড় এবং জ্ঞাতব্য যে, ‘কা’ কোনও ভারতীয় মুসলিমের নাগরিকত্ব বা অধিকার বিন্দুমাত্র খর্ব করতে পারবে না। কারণ এতে কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার সুযোগ নেই, আছে শুধু নাগরিকত্ব দিতে পারার নিয়ম।

ক্যাব ভারত সরকারের এজেন্ডায় দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। গতবারের মতোই অত্যন্ত বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও সরকার এই বিল পাস করতে এবারও বদ্ধপরিকর ছিল। অনেক হোমওয়ার্ক করে এ বছর সরকার ক্যাব সংসদে নিয়ে আসে। যারা আর্টিকল ১৪ নিয়ে কথা বলছেন, হরিশ সালভের মতো আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ এবং প্রাক্তন সলিসিটর জেনারেলও বলেছেন, এতে সংবিধানের কোনও বিধি লঙ্ঘিত হয়নি। ইতিহাসও ক্যাবের স্বপক্ষেই এগিয়ে আসে। গান্ধীজী ১৯৪৭-এ বলেছিলেন, ‘অমুসলিম’ মানুষেরা যখনই পাকিস্তান থেকে এসে ভারতে থাকতে চাইবে, তাদের যেন সম্মানের সঙ্গে থাকা এবং জীবিকা ও মতদানের অধিকার দান করা হয়। আগের সরকারও সে মতই পোষণ করতো।

ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের পর উদ্বাস্তু বাংলাদেশিদের আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০০৩ সালে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। একসময় সংসদে বাংলাদেশের নির্যাতিত সংখ্যালঘুর নাগরিকত্বের পক্ষে জোর সওয়াল করেছিলেন তৎকালীন সাংসদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সবচেয়ে মজার কথা হলো, ২০১২ সালে বামপন্থীরা সোচ্চারে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে সোচ্চার ছিল। তাহলে আজ কেন উল্টো সুরে সবাই সমবেত সংগীত গাইছেন?

এবার জানা যাক, ক্যাব যা কিনা এখন কা-তে বাস্তবায়িত, সেটা আসলে কি? কা বা সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় প্রতারণার কারণে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু, খৃষ্টান, জৈন, শিখ, বৌদ্ধ, পার্সি মানুষের নাগরিকত্ব দেবার লক্ষ্যে গৃহীত। যদিও এই আইনে কোথাও সংখ্যালঘু ভারতীয়দের নাগরিকত্ব খর্ব বা নষ্ট করার বিন্দুমাত্র কোনও সংকেত নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের এই আইনের মারফতে হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তুর ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবার সুযোগ আছে বলে কিছু রাজনৈতিক দল তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তাতে অসম্মতি এবং বিরোধিতা প্রকাশ করছে। এই বিতর্ক এবং অসহযোগে যারা অংশ নিয়েছেন তারা শুধু রাজনৈতিক নেতা নন, আছেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসাধু বা স্বার্থপর বুদ্ধিজীবীও। অত্যন্ত দুঃখের, কা-এর বিপক্ষে যেসব মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বিরোধিতাপূর্ণ সমালোচনা, বিশ্লেষণ, লেখালেখি ইত্যাদি করছেন তারা বেশিরভাগই উচ্চশিক্ষিত!

স্বাধীনতার নামে যেদিন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলো, সেদিনই রাষ্ট্রহীনতার মতো বিষবৃক্ষের বীজ ভারতে বপন হয়েছিল! আর সেদিনই হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে সব থেকে বেশি ত্যাগ আর উৎসর্গে ভরা দীপ্ত হিন্দু বাঙালী জাতি সবচেয়ে অবহেলিত এবং বঞ্চিত! এখনও বার বার তাকে ছিন্নমূল হয়ে হাওয়ায় ভাসতে হয় এক অসহায় খড়কুটোর মতো! ক্ষ্যাপা যেমন খুঁজে ফেরে পরশ পাথর, কমল মজুমদারের ‘তাহাদের কথা’র শিবনাথের মতোই হিন্দু বাঙালিকে কুরে খায় একই প্রশ্ন, ‘আমার দেশ কোথায়’? দেশ টুকরো হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বে, তারপর কোনও প্রতিবেশী ইসলামিক রাষ্ট্র থেকে ধর্মীয় প্রতারণায় ভারতে শরণার্থী হয়ে এলে তা শুধু মানবিকতার খাতিরেই নয়, বাস্তবতার দিক থেকেও কি অযৌক্তিক?

অত্যন্ত বেদনাদায়ক শোনালেও সত্যি যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙালি প্রতিবছর অদ্ভুতভাবে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, যা নিয়ে কারও মনে মানবাধিকার প্রসঙ্গে জাগে না কোনও প্রশ্ন! এরা কি অনিচ্ছায় ধর্মান্তরিত হচ্ছে? খুন হচ্ছে? নাকি পলায়ন করছে এই তিন পন্থায় প্রতারিত বা নির্যাতিত হয়ে? এদের নিয়ে কারও মাথাব্যথা না থাকলেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের অধিকার নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগের শেষ নেই! পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দেয়, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে বীভৎসভাবে হিন্দু জনসংখ্যা কমে গেছে; পক্ষান্তরে এদেশে সংখ্যালঘু নাগরিক শুধু বৃদ্ধি পায়নি, সংখ্যাগুরু বৃদ্ধির সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে!

বর্তমানে যেভাবে বাংলাদেশে হিন্দু আক্রমণ এবং নিগ্রহ হচ্ছে তা দেখে কিছুদিন আগে বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রোফেসর আবুল বরকত বলেছেন, বাংলাদেশ আগামী ত্রিশ বছর পর পুরোপুরি হিন্দুশূন্য রাষ্ট্রে পরিণত হবে। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান হ্রাস এবং মুসলিম জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি অনেকের মনে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। এমনকি যে আফগানিস্তানে ছিল হিন্দু এবং শিখের দু-লক্ষ পরিবার, সেটা পাঁচশোতে এসে দাঁড়িয়েছে। আরও পরিস্কার করে বললে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সৃষ্টি হবার পর ওই দেশ কথানুযায়ী সংখ্যালঘুর সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

এটা যে কোনও নির্বোধ মানুষও বুঝবে যে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান তিন ইসলামিক দেশে ইসলাম ধর্মের মানুষরা ধর্মীয় প্রতারণার শিকার কখনওই হবেন না। তাই ওই তিন দেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষকে ভারতের নাগরিকত্ব দেবার জন্য মিথ্যাচার করে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষে ধ্বংস লীলায় সমর্থন এবং ইন্ধন দেওয়াটা সম্পূর্ণ অনৈতিক, অগণতান্ত্রিক, অমানবিক, অসাংবিধানিক এবং ভারত বিরোধী কাজ।

প্রসঙ্গতঃ এনপিআর, এনআরসি, কা ইত্যাদিকে সংখ্যালঘু বিরোধী চক্রান্ত আখ্যায়িত করার চেষ্টাও রাজনৈতিক ধূর্ততা কিংবা বিদ্বজ্জনের মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। NPR বা National Population Register আমাদের দেশের জনগণের হিসেব রাখার পদ্ধতি মাত্র। যে তথ্য না থাকলে সরকার কখনই কোনও জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ নিতে পারবে না। দেশের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলেও খাঁটি ভারতীয় মাত্রই পুরো পরিচয় সরকারকে জানানো উচিত। দেশে সংখ্যালঘু, অনুসূচিত জাতি ও জনজাতি সহ সবরকম মানুষের হিসেব এবং তথ্য থাকবে এই ডাটাবেজে।

ধরা যাক, দেশের সংখ্যালঘু বা অনুসুচিত জাতির উন্নয়নের জন্য সরকার যদি কখনও কোনও পদক্ষেপ নিতে চায়, সেটা সঠিক বা সম্পূর্ণ তথ্য না জানার জন্য সরকার কখনই বুঝতে পারবে না এ কাজে কি পরিমাণ ফাণ্ড এবং কর্মী জোগান দেবার দরকার। তখন কাজটা অসফল রূপ নেবে। তাছাড়া সুরক্ষা এবং সঠিক জনসংখ্যার রেকর্ড রাখার জন্যও এনপিআর দরকার। পূর্ববর্তী সরকারও এটা বাস্তবায়িত করার অভিলাষ ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু কারণ যাই হোক, অবশেষে করেনি।

আসলে কিছু ধূর্ত সওদাগর ভাবছেন জনগণ সত্যি জানলে তাদের রাজনৈতিক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। সেই ভয়ে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। সঙ্গে আছেন বুদ্ধিজীবী কাকাতুয়া। যারা দিনরাত শেখানো মিথ্যে বুলি কপচে যাচ্ছেন, যাতে মানুষ তাদের ভার দেখে কথার ওজন মেনে নেয়। কিন্তু কিছুদিন কিছু মানুষকে কিছু মানুষ বোকা বানিয়ে রাখতে পারলেও, সবদিন সব মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখা যায় না। একদিন সবাই সত্যি জানবে এবং বুঝবে। সেদিন কিন্তু ভারতের জনগণ তাদের মনের মন্দির থেকে সেই ধূর্ত এবং বোকাটে মানুষগুলোকে নির্বাসিত করে আস্তাকুড়ের জঞ্জালে ছুঁড়ে ফেলে দেবে, তা তিনি যত বড়ই কবি বা শিল্পী হন না কেন। সুতরাং, সাধু সাবধান!  (সমাপ্ত)

Also Read: কা, কা-কা এবং কাকাতুয়া (পর্ব -১), লিখেছেন সুব্রত দাস

(Views expressed in this article are solely of the author and does not necessarily reflect the views of the portal)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker