Barak UpdatesAnalytics
কাঁটাতারের বেড়াঃ ভিতরে ও বাহিরে-৩, লিখেছেন উত্তমকুমার সাহা
কাঁটাতারের বেড়াঃ ভিতরে ও বাহিরে-৩
।।উত্তমকুমার সাহা।।
অন্তরে
কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে কি বাইরে, অসমে বাঙালিদের যন্ত্রণা থেকে রেহাই নেই। যে কোনও অছিলায় তাঁদের যেন বিদ্ধ করা চাই! তাই কাঁটাতার বসানোর পরও তাঁদের পুনর্বাসন নিয়ে কারও যেমন ভাবনা নেই, তেমনি কাঁটাতারের ভেতরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের কখনও ডি ভোটার, কখনও এনআরসি-র নামে হয়রানি চলছে। বিনা দোষে জেলে দিন কাটানো, আত্মহত্যা, মস্তিষ্কবিকৃতির অসংখ্য ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কেন এমনটা, তা জানার জন্য একটু ইতিহাস-ভূগোল নাড়াচাড়া যাক।
দেশভাগের কথা সর্বজনবিদিত। ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহ থেকে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতি ঘটল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। দেশ স্বাধীন হল। সঙ্গে দেশভাগ। সময় প্রবাহে পূর্ব পাকিস্তানও স্বাধীন হল। ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় বাংলাদেশ।
দেশ আলাদা হলো। চিহ্নিত হলো সীমানা। প্রথম অবস্থায় স্থানে স্থানে কিছু পিলার ছাড়া দুই দেশ বোঝার উপায় ছিল না। এর কারণ ছিল রেডক্লিফের সীমানা চিহ্নিতকরণ। তিনি ভারতকে পূর্ব-পশ্চিমে সোজাসুজি বিভাজিত করেন। অন্য কিছুই খেয়াল করতে যাননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সীমানা নির্ধারক কোনও প্রাকৃতিক উপাদান ছিল না। এতে বহু রাজ্যে একাধিক জায়গায় দেশ বিভক্ত হয়েছে। আবার খণ্ডিত ভারতের উত্তর, দক্ষিণ বা মধ্যাঞ্চলে বিভাজনের আঁচ মেলে না।
ভৌগোলিক অবস্থানই স্থির করে দেয়, দেশভাগের ইতিহাস কার ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে। যে সব রাজ্যে আন্তর্জাতিক সীমারেখা নেই, তাঁরা বিষয়টিকে শুধু বই-পুস্তকে ধরে রেখেছেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই সবও বিস্মৃতির পথে। তাদের কাছে ব্রিটিশেরা বৃহত্তর ভারতকে খণ্ডিত করে দিয়ে গিয়েছে, এটা শুধু আক্ষেপেরই বিষয়। কিন্তু রেডক্লিফ যে সব রাজ্যের ওপর দিয়ে সীমানা টেনে নিয়ে গিয়েছেন, সেই রাজ্যের মানুষের কাছে দেশটা শুধু আয়তনে ছোট হয়ে যায়নি। প্রতিদিন তাঁরা দেশভাগের যন্ত্রণা উপলব্ধি করেন।
দেশভাগ হলে যা হয়, এ ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। উদ্বাস্তুর ঢল নামল। পুনর্বাসন হলো। অন্যত্র সবকিছু স্বাভাবিক চললেও অসমে এর রেশ ধরে শুরু হলো সারা অসম ছাত্র সংস্থা (আসু)-র বিদেশি খেদা আন্দোলন। তাদের দাবি, লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি এসে অসমে বসবাস করছে। এরাই একদিন অসম দখল করবে।
আসলে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত অসম ছিল ঘাটতি রাজস্বের অঞ্চল। ব্রিটিশ তাই সিলেট, গোয়ালপাড়া ও আজকের বরাককে বেঙ্গল প্রেসি়ডেন্সি থেকে অসম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে। তখন স্বাভাবিক কারণেই একসঙ্গে প্রচুর বঙ্গভাষী অসমের বাসিন্দা হন। এই কর্মকাণ্ডে তাঁদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের সুযোগ ছিল না।
এ কথা সকলেরই জানা যে, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘিরে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এর জেরে ব্রিটিশকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়। কিন্তু এর ৩১ বছর আগেই, ১৮৭৪ সালে, এরা নীরবে বঙ্গভঙ্গ সেরে নিয়েছিলেন। এর জেরে আজও চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন গোয়ালপাড়া ও বরাকের বাঙালিরা। সিলেটের অধিকাংশটা অবশ্য ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানে যুক্ত হয়ে যায়। শুধু সাড়ে তিন থানা অর্থাত করিমগঞ্জ থানার অর্ধেক এবং রাতাবাড়ি, পাথারকান্দি ও বদরপুর থানার এলাকা সিলেট থেকে খণ্ডিত হয়ে ভারতের নিয়ন্ত্রণে আসে। অসম প্রদেশের কাছাড় জেলার অংশ করা হয় এদের।
ইতিহাস-ভুগোলের এই জটিল জায়গাগুলি না বুঝলে এই অঞ্চলের মানুষের সমস্যা বোঝা যায় না। পরিতাপের কথা, দেশের বাকি অংশের মানুষ তা বুঝতে পারেন না, বা বুঝতে চান না। তাই বিদেশি খেদা আন্দোলনের ইতি ঘটাতে যে অসম চুক্তি হয়, কেউ তার বিরোধিতা করেননি।
কেন্দ্র, রাজ্য সরকার, আসু এবং অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ ১৯৮৫ সালের ১৫ আগস্ট অসম চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ততকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আন্দোলনকারীদের ডেকে কয়েক দফা আলোচনা করেন। তাঁরই উপস্থিতিতে চুক্তিতে সই করেন ততকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব আরডি প্রধান, রাজ্যের মুখ্যসচিব পিপি ত্রিবেদী, আসুর পক্ষে সভাপতি প্রফুল্লকুমার মহন্ত ও সাধারণ সম্পাদক ভৃগুকুমার ফুকন এবং গণ সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আহ্বায়ক বিরাজ শর্মা। তাতে স্থির হয়, ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি হবে নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষ। এর পরে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত যাঁরা অসমে এসেছেন, তাঁদের সংশ্লিষ্ট জেলার রেজিস্ট্রেশন অফিসারের কাছে গিয়ে নাম নথিভুক্ত করাতে হবে। ১০ বছরের জন্য তাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে। ওই মেয়াদের পরই তাঁরা নাগরিকত্বের মর্যাদা পাবেন। ৭১-র ২৪ মার্চের পরে যারা এসেছেন, তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। সে অনুসারে ১৯৮৫ সালেই ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন সংসদে সংশোধন করা হয়। নাগরিকত্ব আইনের বিভিন্ন ধারাকে শিথিল করে ৬ (এ) ধারার সংযোজন ঘটানো হয়।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে আইনে বলা হয়েছে, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত ভারতে যাঁরা জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা জন্মের নথি দেখাতে পারলেই তাঁদের ভারতীয় নাগরিক বলে গণ্য করা হয়। ১৯৮৭ থেকে ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁদের জন্ম, তাঁদের মা বা বাবা একজন ভারতীয় হলেই হল। এর পরে জন্ম যাঁদের, তাঁদের ক্ষেত্রে আইনে বলা হয়েছে, মা-বাবার একজন ভারতীয় হলেই হবে, কিন্তু অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হতে পারবেন না। অসম চুক্তি কার্যকর করতে গিয়ে ওইসব ১৯৮৭, ২০০৪ ইত্যাদির সুবিধে খারিজ করে দেওয়া হয়। একটাই শর্ত, ১৯৬৬-র ১ জানুয়ারির আগে থেকে পূর্বপুরুষের ভারতে থাকার প্রমাণপত্র চাই। বিনা বাক্যে সে দিন লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে বিপন্ন করে একই ভারতে পৃথক নাগরিকত্ব আইন চালু হয়।
একে তো অশিক্ষার দরুন এত পুরনো নথিপত্র বহু মানুষ ধরে রাখতে পারেননি। এর ওপর, দেশভাগ, পুনর্বাসন, দফায় দফায় বন্যা, আগুন, নদীভাঙন ইত্যাদির দরুনও অনেকের সমস্ত মূল্যবান সামগ্রীর সঙ্গে নথিপত্রও নষ্ট হয়েছে। এর চেয়েও বড় ব্যাপার, আইনিশাস্ত্রের মূল্যবান কথা, বিচারের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, দোষীকে শাস্তি দিতে গিয়ে নির্দোষীরা যেন হয়রানির শিকার না হন। কিন্তু অসমে চুক্তির দোহাই দিয়ে বাংলাদেশি সন্দেহে যার-তার নামে নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। ডি ভোটার বা ডাউটফুল ভোটার বলে সন্দেহ করা হলে সমস্ত নথি ঠিকঠাক থাকলেও লাভ নেই। ট্রাইব্যুনালে সে সব তুলে ধরে রায় আদায়ে ১২ থেকে ১৫ বছর সময় লেগে যায়। ওই সময়ে সমস্ত ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। এইভাবে দেশভাগ তাঁদের কাছে চরম অভিশাপ হিসেবে প্রতিদিন উপস্থিত হচ্ছে।
অসম চুক্তির আরও শর্ত ছিল, আর কেউ যেন আন্তর্জাতিক সীমান্ত ডিঙিয়ে অসমে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য ইন্দো-বাংলা সীমানায় দেওয়াল বা কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া, সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর টহলের সুবিধের জন্য সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হবে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কথা প্রথম অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারই উল্লেখ করেছিল। তখন না ছিল বিদেশি খেদা আন্দোলন, না অসম চুক্তি। ১৯৬৫ সালে কেন্দ্র অসম সরকারকে দুটি প্রস্তাব দেয়। এর একটি হল, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অসমের নাগরিকদের আইডেন্টিটি কার্ড প্রদান। সব সময় এই কার্ড তাদের সঙ্গে রাখতে বলা হয়েছিল। রাজ্য সরকার আপত্তি করলে প্রথম প্রস্তাব শুরুতেই খারিজ হয়ে যায়। দ্বিতীয়টি ছিল, আন্তর্জাতিক সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ। সে জন্য সীমান্তের এক কিলোমিটার এলাকায় বসবাসকারীদের সরিয়ে দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তাও অসম সরকার অসম্ভব বলে জানিয়ে দেয়। কারণ হিসেবে উল্লেখ করে, তাতে ২৫ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে তারা সীমান্তের কিছু স্পর্শকাতর অঞ্চল কাঁটাতারে ঘেরার জন্য একটি প্রকল্প জমা করেছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত কাঁটাতার মিলবে না বলে সেই প্রকল্প তখন নামঞ্জুর হয়ে যায়।
অসম চুক্তির পরে পুরো সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। কাজ হয় পর্যায়ক্রমে। প্রথম পর্যায়ে ১৯৮৬ সালে কাজ শুরু হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ শুরু হয় ২০০০-০১ সালে। তৃতীয় পর্যায়ে আগের দুই পর্যায়ের বাকি কাজ এবং প্রথম পর্যায়ের পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। সেই কাজ শুরু হয় ২০০৬-০৭ সালে। এই সময়ে অবশ্য অতি সামান্য বিতর্কিত অংশ বাদে সমগ্র সীমান্তই কাঁটাতারে ঘেরা। তবে একেবারে সীমানায় যেমন নয়, তেমনি পূর্বের কথামতো এক কিলোমিটার এলাকা ছেড়ে দিয়েও নয়। আন্তর্জাতিক রীতি মেনে দেড়শো গজ দূরে এই বেড়া বসানো হয়। তাতেও ধুবড়ি, কাছাড় এবং করিমগঞ্জের ৪৪৩ পরিবার চলে গিয়েছে বেড়ার ওপারে। এই দেশ, এই রাজ্য আমার, এমনটা ভাবার মতো শক্তি তাঁরা ক্রমে হারিয়ে ফেলছেন। বেড়ার এপারের বঙ্গভাষীরাও প্রায় একই অবস্থায়। প্রতি মুহুর্তে তাঁদের সন্দেহ করা হচ্ছে বিদেশি বলে। দফায় দফায় নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিয়েও রেহাই নেই। এখন আবার এনআরসি-তে নাম তোলার জন্য ৪৫-৫০ বছর আগের নথিপত্র খোঁজা হচ্ছে।
কাঁটাতারের বাইরে বসবাসকারী অবশ্য শুধু অসমেই নন, আছেন ত্রিপুরা-পশ্চিমবঙ্গেও। তবে তাঁদের অসমবাসীর মতো যন্ত্রণা নেই। অন্য রাজ্যে শরণার্থীদের এখনও তেমন সরকারি নিপীড়ন সইতে হয় না। ফলে কাঁটাতারের বাইরে বসবাসের জন্য যে সমস্যাগুলি রয়েছে, এর বেশি কিছু ভুগতে হয় না। অসমে বাঙালি শরণার্থীদের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে যে জটিলতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়, কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে বসবাসকারীরা সে সব থেকেও রেহাই পান না। সেইসঙ্গে তাঁদের পুনর্বাসনের কোনও স্পষ্ট নির্দেশিকা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা নানাভাবে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত।
অন্যদিকে, নথিপত্র নিয়ে ছুটছেন মূল ভুখণ্ডের বঙ্গভাষীরা। সবাইকে প্রমাণ করতে হচ্ছে, দেশভাগের নানা যন্ত্রণার মধ্যেও নথিপত্র ঠিক ধরে রেখেছিলেন। এনআরসি নবায়ন করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ হিসেবে ধরার নির্দেশ দিয়েছে। এর পরও ১৯৫১-কে ভিত্তিবর্ষ ধরার জন্য সু্প্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে মামলা চলছে। ফলে বলার অপেক্ষা রাখে না, অসমের বঙ্গভাষীরা স্বস্তিতে নেই। দেশভাগ তাঁদের জন্য নিত্যদিনের বিড়ম্বনা। (সমাপ্ত)
(সৌজন্য স্বীকারঃ অনিমা বিশ্বাস, গাঙচিল কর্তৃক প্রকাশিত ও ঝুমুর পাণ্ডে সম্পাদিত ‘দেশভাগ এক দহন-যন্ত্রণা’)