Barak UpdatesAnalyticsBreaking News
কাঁটাতারের বেড়াঃ ভিতরে ও বাহিরে-১, লিখেছেন উত্তমকুমার সাহা
কাঁটাতারের বেড়াঃ ভিতরে ও বাহিরে
।।উত্তমকুমার সাহা।।
বাহিরে
বছর দুয়েক আগে কাছাড় জেলার কাঁটাতারের বাইরের গ্রাম নাতানপুরে যাই। ৭৭ বছরের বৃদ্ধ ইলিয়াস আলির সঙ্গে দেখা হয় সেখানে। ১৯৪১ সালে নাতানপুরেই তাঁর জন্ম। তখন তাঁরা মোটেও প্রান্তিক অবস্থানে ছিলেন না। ১৯৪৭-এ এলাকায় অফিসারদের আনাগোনা বেড়ে যায়। ‘ভটভটি’ চড়ে নদী পেরিয়ে আসতেন অফিসাররা। পরে পিলার বসানো হয়। সে-সময় তিনি জানতে পারেন, পিলারের ও পারে আরেক দেশ—পাকিস্তান। এরপরও ৬-৭ বছর অবাধে এপার-ওপার করার সুযোগ ছিল। বাড়ির জিনিসপত্র যা প্রয়োজন, এক কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের আটগ্রাম থেকেই কিনে আনা হতো। কারণ ভারতে কাছাকাছি বাজার বললে জালালপুর, ৪ কিলোমিটার দূরে।
সীমানা পেরিয়ে শরণার্থীদের আসার কিছু দৃশ্য এখনও ইলিয়াসবাবুর চোখে ভাসে। নদীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে স্মৃতি আউড়ে চলেন তিনি, পিলার বরাবর এলাকা পেরিয়ে এসেই শরণার্থীরা ভারতের মাটিকে প্রণাম করতেন। কেউ বারবার হাত কপালে ঠেকাতেন। অনেকে আবার শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে বলতেন, চিরদিনের জন্য তোমার মাটি গায়ে মাখলাম। এক ভদ্রলোক বৃদ্ধা মাকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন। মাটিতে শুইয়ে দিয়ে বললেন— মা, এই তোমার দেশ।
‘নদীর এ পারে এসে ঘাঁটি গাড়ে আসাম ব্যাটেলিয়ন। ও-পারে পাকিস্তানি ফৌজ। উভয় পক্ষে নিয়মিত গালিগালাজ চলত। গোলাগুলিও হতো। মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে হতো। ভারতীয় জওয়ানরা সতর্ক করে যেতেন। তখন আমরা কালাইনে গিয়ে থাকতাম’, বলছিলেন ইলিয়াসবাবু।
এই করে করে চলে এলো ১৯৭১ সাল। মুক্তিফৌজ আর পাক সেনায় প্রচণ্ড মারামারি শুরু হলো। কত মানুষ যে মরল! তাঁর কথায়, নাতানপুরে প্রায় সবার বাড়িঘরে মর্টার পড়ছে তখন। তাঁরা ঘরের ভেতরে গর্ত বা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে থাকতেন। একদিনের এক অভিজ্ঞতার কথাও শোনালেন ইলিয়াসবাবু। ‘বাবা বাজারে গিয়েছেন। হঠাৎ দেখি, ঘরের চালে মর্টার পড়েছে। বাড়ির সবাই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড়তে থাকি। আচমকা দেখি, ঠিক মাথার উপরে কীসের শব্দ! সেনা জওয়ানরা আগেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে মাটিতে শুয়ে পড়তে হয়। দ্রুত সবাই এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে প্রাণে বেঁচে যাই।’
সে দিন ওই এলাকায় ৭টি মর্টার পড়েছিল। আরও একদিন ইলিয়াস আলি খেতে বীজ পুঁতছিলেন। আচমকা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আসতে থাকে। দৌড়তে থাকেন সবাই। সেদিনও কোনওক্রমে প্রাণ বাঁচান।
সেই দৌড়, সেই প্রাণ বাঁচানোর প্রয়াস আজও থেমে নেই। বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পরও পুরনো সীমান্ত রয়েই গিয়েছে। কিছুদিন পর নতুন রাষ্ট্রের সঙ্গেও সীমানা বিবাদ শুরু হয়। বেশ কয়েকবার গোলাগুলি চলে। ফের তাঁদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র রাতযাপন। সে-সব তবু মেনে নিচ্ছিলেন ইলিয়াস আলি, অনিল দাসেরা। কিন্তু এর পরই বসে কাঁটাতারের বেড়া। ‘আমাদের বুক চিরেই যে দেশটা ভাগ হয়েছে, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাই’ — বলছিলেন অনিল দাস। ইলিয়াস আলির পাশেই বসেছিলেন তিনি। চোখের জল মুছতে মুছতে অভিমানী হয়ে ওঠেন, ‘কে বলে আমরা ভারতীয়!’
কাছাড় জেলায় মূল ভূখণ্ডের বাইরে রয়েছে ৬৯ বাড়ির ১৭৪টি পরিবার। করিমগঞ্জ জেলায় রয়েছে ১৪৪ পরিবার। ধুবড়িতে ১২৫। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের জন্য গেট রয়েছে বটে, কিন্তু দীর্ঘপথ পেরিয়ে গেলেই একটি গেট দেখা যায়। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কড়া প্রহরায় সেই গেট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে খোলে ও বন্ধ হয়। বিশেষ করে, সূর্যাস্তের পরে ওই দেড়শো গজই তাদের জন্য পৃথক এক দেশ। তখন গেট পেরনো বিশাল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। গেট খোলা কি বন্ধ, পানীয় জলের জন্য তাঁদের নিত্য ভোগান্তি। পানের হোক বা স্নানের —নদীই একমাত্র ভরসা। একশো শতাংশ মানুষের জীবিকা কৃষিকাজ। কিন্তু গেট নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রায় তাঁরা প্রাচীন যুগে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। জমিচাষ করেন শুধু নিজের পরিবারের প্রয়োজনে। কারণ উৎপাদিত সামগ্রী বাজারে নিয়ে বিক্রি করা কঠিন। ঘড়ি ধরে, গেটের দিকে চোখ রেখে জিনিসপত্র নিয়ে বেরনো অনেকসময়েই সম্ভব হয় না। তার চেয়ে বড় কথা, সূর্যাস্তের আগে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে না পারলে সে-রাতে বাড়ি ফেরার সুযোগ নেই। গেটের পাশে বসেই রাত কাটাতে হয়। সেজন্য একসময় যারা গেট পেরিয়ে দিনমজুরি করতেন, তাদের সেই কাজ ছাড়তে হয়েছে।
অন্যত্র ধর্ম, গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠী, রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে লড়াই চললেও কাঁটাতারের বাইরে ইলিয়াস আলি আর অনিল দাসের সমস্যায় কোনও ফারাক নেই। গেটের যন্ত্রণার জন্য তাঁদের বাড়িঘরে আত্মীয়-স্বজন যেতে পারেন না। যানও না কখনও। এর দরুন ছেলেমেয়েদের বিয়ে আটকে রয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙানোর ঝামেলার কথা ভেবে না-কেউ ছেলের বিয়ে দিতে চান তাঁদের পরিবারে, না তাঁদের মেয়ে নিতে চান।
(সৌজন্য স্বীকারঃ অনিমা বিশ্বাস, গাঙচিল কর্তৃক প্রকাশিত ও ঝুমুর পাণ্ডে সম্পাদিত ‘দেশভাগ এক দহন-যন্ত্রণা’)