Culture
কবিতা পাঠ : এক ভিন্নমাত্রিক শিল্প
দীপক সেনগুপ্ত
কবিতা পাঠ করা হয়, না আবৃত্তি করা হয়,এই নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। আসলে পাঠ ও আবৃত্তির মধ্যে প্রায় অদৃশ্য অতি সূক্ষ এক বিভাজন রেখা প্রাজ্ঞমহলে দৃশ্যমান হলেও কলাকুশলীদের ক্ষেত্রে অদৃশ্য থেকে যায়। যার জন্য হয়তো নবীন সঞ্চালিকা বা সঞ্চালক পরবর্তী অনুষ্ঠান আবৃত্তির এই কথা ঘোষণা করলেন,কিন্তু দেখা গেল শিল্পী কবিতা পাঠ করছেন বা উল্টোটাও দেখা যায় অর্থাৎ কবিতা পাঠ করে শুনবেন বলার পর দেখা গেল আবৃত্তি করলেন বাচিকশিল্পী। অনভিজ্ঞতা ও অজ্ঞতা এবং অবশ্যই পড়াশোনায় অরুচি এর জন্য দায়ী।
একজন গীতিকার গান রচনা করেন তারপর তিনি নিজে অথবা অন্য কেউ সুর দেন এবং অন্যান্য যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীদের সাহচর্যে গান মঞ্চস্থ হয়। সুর, তাল, লয়, মিলেমিশে একাকার হয়ে এক একটা সার্থক গান তৈরি হয়। আরও একটা কথা, গান রচিত হয় গাওয়ার জন্য, অন্যথায় গান লেখার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু কবি যখন কবিতা লিখেন তখন তিনি নিজেই জানেন না এটা কেউ পাঠ বা আবৃত্তি করবেন কি না। কবিতায় কবি ও আবৃত্তিকারের মধ্যে অন্য কেউ নেই, আছে শুধু ছন্দ বা ভাব। যন্ত্রশিল্পী থাকলেও ভূমিকা খুব গৌণ। কবির ভাবকে উপস্থাপন করে দর্শক শ্রোতার মনে দৃশ্যকল্পের জন্ম দিতে পারলেই কবিতা পাঠ বা আবৃত্তির সার্থকতা। সব কবিতা পাঠ বা আবৃত্তির জন্য যোগ্য নয়, বিশেষ আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য।
কোনও ভাষা যখন উন্নতির সোপানের দিকে এগিয়ে চলে তখন ছন্দের নিগড় ভেঙে গদ্যের পরিসরে কবিতা হানা দেয়। যেমন দেখি শ্রীজাত সহ অনেক আধুনিক কবির কবিতার ক্ষেত্রে, যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজেও অনেক গদ্য কবিতা লিখে গেছেন। উদাহরণ হিসাবে ” নিমন্ত্রণ ” কবিতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তার জন্য শ্রীজাত সহ প্রায় সব আধুনিক কবির কবিতা পাঠ করা বা রবীন্দ্রনাথের ” লিপিকা” কাব্যগ্রন্থের কবিতাকে পাঠ করা যেতে পারে। কিন্তু আবৃত্তি বলার ক্ষেত্রে অসুবিধা অনেক। যেহেতু এইসব কবিতায় ছন্দের ওঠানামা বা ব্যাকরণগত অলংকার অনুপস্থিত, তাই আবৃত্তি না বলে পাঠ বলাটাই শ্রেয় হবে। যদিও অনেকের মতে, এমনকি ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ও, মুখস্থ উপস্থাপন করাটাকেই আবৃত্তি বলা উচিত বলে মত ব্যক্ত করেছেন। আবার অনেকের মতে, ছন্দ-অলংকার বিহীন কবিতার মুখস্থ উপস্থাপনকেও কবিতা পাঠ বলা যেতে পারে। উদাত্ত গলা থাকা অবশ্যই প্রাথমিক শর্ত সফল আবৃত্তিকারের, কিন্তু শেষ শর্ত অবশ্যই নয়। কেননা শিল্পীর কবিমন থাকতে হবে, কাব্যের ভাষা ও ভাবকে আত্মীয়করণ করাটা অন্যতম আবশ্যিক শর্ত। সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি, এই কথা আবৃত্তিকারের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। হাজার বছরের পথ হাটার ক্লান্তি ও বনলতাকে দেখার তৃপ্তি শুধু শব্দ নিক্ষেপনের মধ্যে এক বিমূর্ত প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে বোঝানোর মত দুঃসাধ্য কাজ করতে হলে বাচিক শিল্পীকে অবশ্যই প্রশিক্ষিত হতে হবে ।এই প্রশিক্ষণের জন্য চাই দক্ষ গুরু, চাই কর্মশালা ,যাতে নিজের গলার মাধুর্য ও উদাত্তস্বরকে নিয়ন্ত্রিত করে তার ওঠানামার মধ্যে দিয়ে সৃষ্ট শব্দের লহরী মহাশূন্যে দৃশ্যের কোলাজ তৈরি করে।
কোনও কোনও আবৃত্তিকারের ” সিগনেচার টিউন” থাকে যেমন কাজী সব্যসাচীর “বিদ্রোহী” কবিতা বা শম্ভু মিত্রের ” মধু বংশীর গলি” যেমন গানের ক্ষেত্রে দেখি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের “রাণার” বা কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের ” আনন্দধারা বহিছে ভুবনে” ইত্যাদি ইত্যাদি। কোন শিল্পী “বিদ্রোহী ” কবিতা আবৃত্তি করতে গেলে নিজের অবচেতনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা কাজী সব্যসাচী বেঁচে উঠবেন আর এখানেই শিল্পী ফেল করলেন। কেননা অনুকরণ এমন কি অনুসরণ করে জাতশিল্পী হওয়া যায় না,এই ক্ষেত্রে নিজের স্বকীয়তা অবশ্যই থাকতে হবে। বাচিক শিল্প মানেই কবিতা পাঠের বা শ্রুতিনাটকের চর্চা নয় তার বৃত্তিকারী ভূমিকা ও আছে। আজকের বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বিশেষত এফ এম রেডিওর জোকি থেকে শুরু করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর সফল সঞ্চালনার ক্ষেত্রেও বাচিক শিল্পীর প্রয়োজন। আঞ্চলিক কথ্যভাষাকে অতিক্রম করে মান্যভাষা চর্চা করার উপর এবং নিত্যদিনের ব্যাবহারিক জীবনে শুদ্ধ উচ্চারণ ধ্বনি প্রয়োগের উপর বাচিক শিল্পীর সফলতা নির্ভর করে। এই ক্ষেত্রে কর্মশালা আয়োজন ও তাতে যোগদানের উপর কোন কোন জায়গার বাচিক শিল্পচর্চার উৎকর্ষতা নির্ভর করে। পরিশেষে বলি, সময়ের পথ চলায় যে কোনও শিল্প যদি বিষয় ও আঙ্গিকের দিক থেকে রূপ থেকে রূপান্তরের পথে হেটে যেতে না পারে তবে একদিন বন্ধ্যাত্বের করাল গ্রাসে সে অবলুপ্ত হবে। এই কথা মাথায় রেখেই শিল্পীকে অনন্তকাল পথ চলতে হবে।