Barak UpdatesBreaking News
এক ব্যতিক্রমী চিকিৎসক ছিলেন অরূপ ভট্টাচার্য
-দেবযানী চৌধুরী-
কেউ বলতো পাগল ডাক্তার, কেউ বলতো অসম্ভব বদমেজাজী, তারপরও একটা সময়ে তিনিই ছিলেন বরাকের স্বনামধন্য চিকিৎসক, রোগ নির্ণয়ে দক্ষহস্ত। তিনি ডা. অরূপ ভট্টাচার্য।
তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনও পরিচয় ছিল না, যতটুকু অভিজ্ঞতা তাঁকে নিয়ে, তা কখনও রোগী হিসেবে, আর রোগীর মেয়ে হিসেবে। মেয়েবেলায় অসুখে-বিসুখে তাঁর কাছে আমার মা নিয়ে গেছেন চিকিৎসার জন্য। রোগী দেখার ব্যাপারে তিনি খুব নিয়ম মেনে চলতেন, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া যে দুটো ফার্মাসিতে তখন তিনি বসতেন, সেগুলোতে কুড়িটির বেশি পেশেন্ট দেখতেন না। আজকালকার মতো চিকিৎসাসেবা তখন এতটা ব্যবসা হয়ে ওঠেনি। অনেক চিকিৎসকই তখন আদর্শ মেনে চলতেন। অরূপ ভট্টাচার্য ছিলেন তাদের অন্যতম। একশ টাকা ভিজিট ছিল, এক ভিজিটে তিনবার অব্দি দেখানো যেত ডাক্তারকে।
আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। আমার বাবা ছিলেন চেন স্মোকার। দিনের দুই-চার প্যাকেট সিগারেট টানতেন। সেসময় আমার বাবা খুব কাশিতে ভুগছিলেন।প্রথমদিকে আমরা ভেবেছিলাম বেশি সিগারেট খাওয়ার জন্য এই কাশি। কাশির জন্য বাবা বেশ কষ্ট পাচ্ছিলেন। দ্বারস্থ হলাম ডাঃ অরূপ ভট্টাচার্যের কাছে। সবাই বদমেজাজি বললেও আমি যতদিন তাঁর কাছে গেছি, বদমেজাজের পরিচয় পাইনি। কথা কম বলতেন। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতেন না। আমার বাবাও ছিলেন খুব বদমেজাজি, একটুতেই মেজাজ বিগড়ে যেত। কাকে কী বলতেন কোনও ঠিক থাকত না। আর আমার বাবা নিজের অসুখকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিলেন না, তাঁর ধারনা ছিল, এটা সামান্য কাশি, এমনিতেই কমবে। এতসবের জন্য অরূপ ভট্টাচার্যের মতো একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে সাতপাঁচ ভাবছিলাম, যদি ডাক্তার বাবার ব্যবহারে বিরক্ত হন, বা ডাক্তার বাবাকে কিছু উপদেশ দিতে যান, আর বাবা কিছু উল্টোপাল্টা কথা বলে দেন।
যাইহোক, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাবাকে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। আজকাল তো চিকিৎসকের কাছে সামান্য জ্বর নিয়ে গেলেও চিকিৎসকরা কিছু ওষুধের নাম লিখেই আগে একগাদা টেস্টের ফর্দ দিয়ে দেন। এটা ঠিক না বেঠিক এই বিতর্কে না গিয়ে বলবো, এমনও কিছু চিকিৎসক আছেন বা ছিলেন, যারা রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে রোগ সম্পর্কে একটা ধারনা করে নিতে পারেন, যা নির্ভুলও হয়। অরূপ ভট্টাচার্য ছিলেন তাদের একজন। বাবাকে নিয়ে যাওয়া হল ডাক্তারের আছে। ডাক্তার আর রোগীর মধ্যে যদি কোনও অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া নিয়ে যে ভয় পেয়েছিলাম, সেটা হলো না। জানি না কেন, হয়তো মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ দেখে, ডাক্তারের এতদিনের ব্যবহারেও যেন একটু পরিবর্তন দেখলাম, তিনি গল্প করার ছলে বাবার সমস্যার ব্যাপারে জেনে নিলেন। পরীক্ষাও করলেন, বললেন, এই কতটা দিন সিগারেট খাওয়া বন্ধ রাখতে।
তারপর প্রেসক্রিপশন লিখলেন, পনেরো দিনের ওষুধ। বললেন ওষুধ খেয়ে আবার আসার জন্য। তবে মাঝখানে যদি প্রবলেম বাড়ে, তাহলে যেন সঙ্গে সঙ্গে আসেন, এমনকি এরজন্য আগে কোনও টোকেনের দরকার নেই, এসে যেন প্রেসক্রিপশনটা পাঠানো হয় তাঁর কাছে, তিনি নিজেই ডেকে নেবেন।
পনেরো দিন পার হলো, ওষুধ খেয়ে কাশিটা একটু কমল। বাবা আর ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলেন না। কিছুদিনের মধ্যে স্বরভঙ্গ হলো বাবার। ভারি খাবার খেতে অসুবিধা হতো। পা ফুলে গেল। একমাসের মধ্যেই এতসব হয়ে গেল। বাবাকে আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো, সেদিনের একটা ছবি এখনও আমার মনের মনিকোঠায় প্রোজ্বল। বাবার পোশাক ছিল শার্ট প্যান্ট আর জুতো। পা ফোলার জন্য বাবা চট করে নুইয়ে জুতোর ফিতে খুলতে পারতেন না। ডাক্তার বাবার পা দেখবেন বলে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন, নিজে মাটিতে বসে বাবার জুতোর ফিতে খুলে জুতো খুললেন। বাবার পাশে সেদিন মা আমি দুজনে ছিলাম। ডাক্তার আমাদের কাউকে বলতে পারতেন জুতো খুলে পা দেখানোর জন্য, কিন্তু তিনি বাবাকে বললেন, আপনার পা ফোলাটা দেখব, জুতো খুলতে পারবেন তো। বাবা যেই বললেন, একটু কষ্ট হয় নুতে, আমাদের হতবাক করে সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়েন নিজের সিট থেকে, রোগীর জুতোতে হাত দিতে তাঁর আত্মসম্মান আর দেমাগে বাঁধেনি। তিনি হয়ত সেদিনই বুঝে ফেলেছিলেন, বাবার মারনরোগ হয়েছে। আজকাল ক’জন এমন সহানুভূতিশীল ডাক্তার দেখা যায়? রোগী মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাড়িয়ে থাকলেও এনারা ব্যবসায়িক হিসেব কষেন।
যাইহোক, এবার তিনি কিছু টেস্টের নাম লিখে দিলেন প্রেসক্রিপশনে। তখন টেস্টের ব্যাপারে, রোগের ব্যাপারে এত অভিজ্ঞতা ছিল না, একটা টেস্ট ছিল গলার গ্ল্যান্ড থেকে লিকুইড জুস নিয়ে টেস্ট, ওটা মুম্বাই পাঠাতে হবে, ওই রিপোর্টটাই মেইন বললেন। বাবার সব টেস্ট করানো হলো। নির্দিষ্ট সময়ে রিপোর্ট এল, রিপোর্ট নিতে গেলাম, লিখা ছিল- কারসিনোমা, তখনও জানতাম না, কারসিনোমা মানে যে ক্যান্সার, রিপোর্ট নিয়ে সোজা গেলাম ডাক্তারের কাছে। টোকেন করতে হয়নি, প্রেসক্রিপশন আর রিপোর্ট ফার্মাসির ছেলেটাকে দেখিয়ে ঢুকলাম তাঁর চেম্বারে। সব রিপোর্ট দেখে বললেন, বাবার হার্ট আর লাঙসের মাঝখানে একটা জায়গা আছে মিডিয়াস্টেন, ওখানে ক্যান্সার হয়েছে। রোগটি লাস্ট স্টেজে আছে, ওখানে অপারেশনও করা যাবে না। স্বাভাবিকভাবেই এমন একটি খবরে ডাক্তারের সামনেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেদে উঠেছিলাম, কিন্তু ডাক্তার আমাকে না একটা সান্ত্বনাবাণী শুনিয়েছিলেন, না কিছু বলেছিলেন, চশমাটা হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসেছিলেন।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, রিপোর্টটাতো ভুলও হতে পারে। মাথা নিচু করেই বলেছিলেন, না, রিপোর্ট ঠিক আছে। বলেছিলাম, বাঁচার কি কোনও চান্স আছে? একইভাবে আমার দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, না। সেদিন আমার খুব খারাপ লেগেছিল ডাক্তার অরূপ ভট্টাচার্যের ব্যবহারে। আশা করেছিলাম আশ্বাসবাণীর, একটু সহানুভূতির ভাষার। বাবার মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার অনেক বছর পর বোধের গভীরতায় অনুভব হয়েছে। হয়তো সেদিন ডাক্তার হিসেবে নিজের হার দেখেছিলেন, যেখানে তার কোনও চিকিৎসার ক্ষমতা ছিল না। তাই হয়তো সেদিন তিনি আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেননি। চুপ ছিলেন, আজ ডাঃ অরূপ ভট্টাচার্যের মৃত্যুর খবরে, কেন জানি না অন্তরের অন্তরমহলে অনুভব হচ্ছে, সেদিনও তিনি চিকিৎসক হিসেবে ক্যান্সারের কাছে হার মেনেছিলেন। আর এবার তার জীবন হার মানল সেই ক্যান্সারের কাছে।