Barak UpdatesCulture

রেকর্ড সংখ্যক প্রতিযোগীর অংশগ্রহণে ছোট্ট প্রচেষ্টার রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী

বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক অবক্ষয় রোধে বেশ কয়েক বছর ধরেই কাজ করে যাচ্ছে শিলচরের ছোট্ট প্রচেষ্টা নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।এরই অঙ্গ হিসেবে প্রতি বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে গ্রীষ্মের বন্ধে রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপন করা হয়।এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ৯ জুলাই সোমবার নেতাজি বিদ্যাভবন গার্লস হাইস্কুলে তিনদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ হয়।ওইদিন সকাল দশ টায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলনে উপস্থিত ছিলেন সংস্থার উপদেষ্টা বিক্রমজিৎ চক্রবর্তী,দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়,রাজীব চৌধুরী, সভাপতি পূর্নেন্দু দাস,বিশিষ্ট যন্র শিল্পী প্রবীর ভট্টাচার্য,বিপ্লব অধিকারী প্রমুখ।নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা তথা নবপ্রজন্মের বিকাশ সাধনে এ ধরনের অনুষ্ঠানের কতটুকু গুরুত্ব তা সহজ ভাষায় দর্শকদের বুঝিয়ে বলেন দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়। পাশাপাশি ছোট্ট প্রচেষ্টার এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন। তাঁর ভাবনা প্রকাশের পরই শুরু হয়ে যায় রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত এবং কবিতা প্রতিযোগিতা।বিশাল সংখ্যক প্রতিযোগীর অংশগ্রহণ দেখে আয়োজকরা স্কুলের তিনটে বড় বড় কক্ষে একসঙ্গে প্রতিযোগিতা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হয়ে বিকেল ৫টা নাগাদ শেষ হয় সেদিনের প্রতিযোগিতা।এতে অংশগ্রহণ করেন ২০৯ জন প্রতিযোগী।
সঙ্গীতে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীদের উৎসাহ বৃদ্ধির লক্ষে প্রত্যেক প্রতিযোগীর সঙ্গে তবলার সঙ্গত নিশুল্ক রাখা হয় সংস্থার পক্ষে।সেদিন রবীন্দ্র সঙ্গীতে বিচারক হিসেবে ছিলেন প্রবীর ভট্টাচার্য ও যুথিকা দত্ত বণিক।নজরুল গীতিতে ছিলেন ধুর্জটি প্রসাদ দত্ত আর কবিতা প্রতিযোগিতায় ছিলেন সব্যসাচী পুরকায়স্থ।
১০ জুলাই ছিলো নৃত্য প্রতিযোগিতা। এদিনও দিনভর অনুষ্ঠান চলে। এতে অংশগ্রহণ করেন ১৭২ জন প্রতিযোগী।নৃত্যে বিচারক হিসাবে ছিলেন শিপ্রা পুরকায়স্থ ও চন্দ্রিমা মজুমদার।দু’দিনের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় মোট অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীর সংখ্যা ৩৮১ জন, যা বরাক উপত্যকায় এক নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে।প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক প্রতিযোগীকে সংস্থার পক্ষ থেকে প্রশংসাপত্র প্রদান করার রীতি ছোট্ট প্রচেষ্টার প্রথম থেকেই।
১১জুলাই, বুধবার ছিলো অনুষ্ঠানটির শেষ দিন।নব আনন্দে জাগো গানটিতে নিকিতা চন্দের নৃত্যের মাধ্যমে সকাল ১১ টায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।সুনিতা শর্মা মজুমদারের নেতৃত্বে ‘আমরা নতুন যৌবনেরই দূত’ এবং ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’ এই দুটি সমবেত রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন সংস্থার সদস্যরা।শ্রুতি মিউজিক অ্যাকাডেমির খুদে সঙ্গীত শিল্পীদের দ্বারা ‘শিউলি তলায় ভোর বেলায়’ গানটি কোরাস পরিবেশিত হয় মেঘা দাসের তত্বাবধানে।সুনিপা শুক্লবৈদ্য একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন।শিল্পীর প্রতিভা আছে রবি ঠাকুরের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতাটি খুবই সুন্দর আবৃত্তি করেন মন্দিরা ঘোষ।তারপর ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে’ গানটিতে নৃত্য পরিবেশন করেন মনিষা নাথ।মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয় অতিথি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী নবনিতা দাসকে।শিল্পীর কণ্ঠে ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে’ আর ‘তোমার খোলা হাওয়া’ গান দুটি পরিবেশনে অনুষ্ঠানকে উচ্চ মাত্রা এনে দেয়।শিল্পীর সঙ্গে তবলায় ছিলেন ভাষ্কর দাস।শিশুশিল্পী কুনাল নাহার কন্ঠে পরিবেশিত হয় ‘মধুর বাঁশরী বাজে’ গানটি।শিল্পীর গায়কী আর পরিবেশনের সঙ্গে তাঁর নিজের আত্মার আত্মীয়করণ সবাইকে মুগ্ধ করে।তারপর মঞ্চে আসেন গৌড়ীয় নৃত্য কলা ভারতীর আট জন খুদে নৃত্য শিল্পী।’আজি মনে মনে লাগে হরি’ গানটায় শিল্পীরা অপূর্ব নৃত্য দেখান।’নিশিদিন ভরসা রাখিস’ ও ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ গান গুলো কোরাস পরিবেশ করেন শ্রুতি মিউজিক অ্যাকাডেমির বড় শিল্পীরা। সঙ্গীত কলা মহাবিদ্যালয়ের শিশুশিল্পী গৌতমী মালাকারের কণ্ঠে একে একে পরিবেশিত হয় ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন’, ‘মনেপড়ে আজ’ নজরুলের এই গানগুলো। শিল্পীর সুর, তাল, লয় সব বিভাগই দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। বৈশালি চক্রবর্তী পরিবেশন করেন ‘প্রিয় যাই যাই বলো না’ গানটি। ‘ভানু সিংহের পদাবলি’তে সুন্দর একটি নৃত্য পরিবেশন করেন শান্তশ্রী আচার্য। তারপরেই আরেকটি নৃত্য পরিবেশন করেন মনিষা দাস। অপর্ণা দেবনাথ তার সুরেলা কণ্ঠে শোনান ‘ময়না মতির শাড়ি দেব’ গানটি, তার দ্বিতীয় পরিবেশনা ছিল ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে’ গানটি। অসাধারণ কিছু নতুন প্রতিভার সন্ধান পাওয়া গেলো ছোট্ট প্রচেষ্টার এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সাংস্কৃতিক এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মেঘা দাস। তবলায় ছিলেন বিপ্লব অধিকারী, সিন্থেসাইজারে সন্দীপ ভট্টাচার্য, অক্টোপেডে অনুপম মণ্ডল।
ছোট্ট প্রচেষ্টা স্থির করেছিল রবীন্দ্র নজরুল জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রত্যেক বছর এই উপত্যকার একজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে সম্মানিত করবে। এবার থেকেই তার শুভারম্ভ হয় সঙ্গীত সাধক তাপস শংকর দেবকে সংবর্ধিত করে। দুই শিশু শিল্পী দীক্ষা দেব ও শ্রেয়া দাস ‘অঞ্জলি লহ মোর’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে অন্য মাত্রা এনে দেয় অনুষ্ঠানে। ছোট্ট প্রচেষ্টার মুখ্য উপদেষ্টা নীলোৎপল চৌধুরী এবং কাছাড়ের প্রাক্তন অতিরিক্ত জেলা উপায়ুক্ত বীরেশ চন্দ্র নাথ যিনি ছোট্ট প্রচেষ্টার উপদেষ্টাও, তাঁদের দ্বারা সম্মাননা স্মারক দিয়ে সংবর্ধিত করা হয় তাপস শংকর দেবকে। এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অবক্ষয় রোধে ছোট্ট প্রচেষ্টা যেভাবে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরে তার জন্য তাপস বাবু সংস্থার ভুয়সী প্রশংসা করেন।বআগামী দিনে সাংস্কৃতিক বিভাগে এই সংস্থাকে নিয়ে আগে বাড়ার স্বপ্ন দেখান।
তারপর শুরু হয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণী সভা। এতে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন নীলোৎপল চৌধুরী, বীরেশ চন্দ্র নাথ, তাপস শংকর দেব, বিভূতিভূষণ গোস্বামী, বিক্রমজিৎ চক্রবর্তী, তারাশঙ্কর দাস,শিপ্রা পুরকায়স্থ, শম্পা ধর প্রমুখ। পুরস্কার বিতরণ শেষে নীলোৎপল চৌধুরী তাঁর ছোট বক্তৃতায় নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষার মূল্যবোধ সম্বন্ধে সহজ ভাবে বুঝিয়ে বলেন শ্রোতাদের। তিনি বলেন, বরাক উপত্যকায় আরও কয়েক ধরনের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা দরকার নবপ্রজন্মের সংস্কৃতি সাধকদের জন্য, যাতে করে তারা তাদের প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পায়। বিভূতিভূষণ গোস্বামী তাঁর বক্তৃতায় ছোট্ট প্রচেষ্টার সদস্যদের অনেক উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করেন যাতে সবাই মিলে এমন কর্মযজ্ঞ বার বার আয়োজন করা হয়। সমাজের ক্ষয় রোধে দু’জনেই নবপ্রজন্মদের আরোও বেশি সংখ্যায় এগিয়ে আসার আহবান জানান।
কিছুদিন আগে ছোট্ট প্রচেষ্টার সোনাই রোডের কার্যালয়ে ১০ দিন ব্যাপী স্পোকেন সংস্কৃতের এক কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে শিলচরের বিভিন্ন কলেজের ২৫ জন ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করেন। সেদিনই ওই পঁচিশজনকে সংস্থার পক্ষে প্রশংসাপত্র প্রদান করা হয়। ছোট্ট প্রচেষ্টার উপদেষ্টা রাজীব চৌধুরী বলেন, সাংস্কৃতিক চর্চা বৃদ্ধিতে এ ধরনের প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান বিশেষ অবদান রাখে। এতো বিশাল সংখ্যক প্রতিযোগীর অংশগ্রহণে তাঁরা খুবই উৎসাহিত এবং আনন্দিত। তিনি আরও বলেন, আগামী দিনে সংস্থার সাংস্কৃতিক বিভাগটায় কিছুটা শক্তি বাড়িয়ে অন্যান্য ধারাবাহিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করারও ইচ্ছে রয়েছে। প্রতিযোগীদের জন্য এই রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী এমনই একটা সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নিজের প্রতিভা প্রকাশে এখন অনেকেই এগিয়ে আসছেন। প্রত্যেক বছরই নতুন কিছু অসাধারণ প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই জন্য বড় পাওনা। সাংস্কৃতিক চর্চায় নবপ্রজন্মদের জন্য একটা স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম এর ব্যবস্থা করে দেওয়াই তাঁদের লক্ষ। তিনি বলেন, সংস্থার আর্থিক দুর্বলতাই তাদের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বার বার।  

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker