Barak UpdatesIndia & World UpdatesAnalytics
বিশ্ব সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করলেন শনবিল ফাকুয়ার নৃপেন্দ্র, লিখেছেন সুশান্ত মোহন চট্টোপাধ্যায়
১২ জুন : সম্প্রতি আরবের দুবাই শহরে অনুষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক সম্মেলন। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বের ১৯০টি দেশের প্রতিনিধিরা। এই সম্মেলনে ভারতের ১৩৫ কোটি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করলেন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক জলাশয় শনবিল এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম ফাকুয়ার ছাব্বিশ বছর বয়সী নৃপেন্দ্র দাস। মনোবল যদি ঠিক থাকে তবে কোনও বাধাই বাধা নয়, তা আবারও প্রমাণ করলেন এই যুবক। দুবছর আগে ইন্দোনেশিয়ার বালি শহরে দেশের হয়ে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। নৃপেন্দ্র দাস গত বছর ডিসেম্বর, ২০২০ থেকে এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস সময়ে একক প্রচেষ্টায় সাইকেলে চড়ে সারা ভারত ভ্রমণ করেছেন। প্রচণ্ড শীতকে উপেক্ষা করে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, আসাম থেকে গুজরাট প্রায় সব রাজ্য ভ্রমণ করে যুব সম্প্রদায়কে এক নতুন বার্তা দিয়েছেন তিনি। হরিভক্ত দাস ও জ্যোৎস্নারানি দাসের ছেলে নৃপেন্দ্র বর্তমানে নর্থ ইস্ট হিল ইউনিভার্সিটির স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। তাঁর বিষয় সমাজ বিজ্ঞান। অত্যন্ত গরিব পরিবারের মেধা সম্পন্ন ছেলেটি নিজের ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করে আজ বিশ্ববাসীর কাছে ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে পরিচিতি লাভে সমর্থ হয়েছে।
করিমগঞ্জ জেলায় থাকা শনবিলের এক দুর্গম অঞ্চল ফাকুয়া গ্রাম। সেখান থেকে মূল পূর্ত সড়কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুকনো মরশুমে দুঘন্টা সময় নিয়ে প্রায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে হয়। বর্ষার সময় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সেই একই রাস্তা নৌকায় আধঘন্টা সময়ে অতিক্রম করা যায়। এতসব বাধাকে অতিক্রম করে নৃপেন্দ্র এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর লক্ষ্যে।
গত ২৭ মে, ২০২২ থেকে ৩০ মে, ২০২২ পর্যন্ত ইউনাইটেড ন্যাশনস্ অর্গেনাইজেশনের অধীনে দুবাইতে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বের ১৯০টি দেশের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। বিষয় ছিল, ওয়ার্ল্ড ফেইসিং প্রেজেন্ট প্রব্লেমস্ (বর্তমান বিশ্বের সমস্যা)। দুবাইয়ের “আরব ইয়ুথ ইন্টারন্যাশনাল মডেল ইউনাইটেড ন্যাশনস্”-এর আমন্ত্রণ পেয়ে প্রথমে তিনি ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিদেশ মন্ত্রকের তরফে যাত্রার ১০-১৫ দিন আগে পাঁচদিনের জন্য তাঁকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর ভারত সরকারের আর্থিক সহায়তায় তিনি সেখানে যান। তাঁর উপস্থাপনার নির্দিষ্ট তারিখ ছিল ২৮ মে। সাধারণ সভায় তিনি মোট নয়টি বিষয়ে বক্তব্য রাখেন এবং এ ব্যাপারে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে বিশ্বসাসীর কাছে বক্তব্য তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল,
(১) রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ভারত সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান সহ অচিরে এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শেষ করার আহ্বান। তাছাড়া বিধ্বস্ত ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকদের জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে করা মানবিক সাহায্যের বিভিন্ন দিকও তিনি তুলে ধরেন।
(২) উগ্রপন্থা সমস্যা নিয়ে কথা বলেন তিনি। সমগ্র বিশ্ব এখন উগ্রপন্থী সমস্যার সম্মুখীন। ভারত কখনও উগ্রপন্থীদের সাহায্য বা সহযোগিতা করে না। এই উগ্রপন্থা সমস্যা নিরসনে সমগ্র বিশ্বকে এক হয়ে লড়াই করার আহ্বান জানান তিনি।
(৩) সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর উগ্র মৌলবাদীদের আক্রমণ ও এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের জনজীবনে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে এইসব কার্যকলাপ অচিরে বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা স্থির করা ও সত্ত্বর রূপায়ণের কথা উল্লেখ করেন।
(৪) পাকিস্তানের উগ্রপন্থীদের দ্বারা জম্মু ও কাশ্মীর সহ সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যে জঙ্গি কার্যকলাপের নেটওয়ার্ক চলছে, এতে ভারতের সাধারণ নাগরিক সহ পর্যটন ক্ষেত্র ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিদেশী পর্যটকরা এখন এইসব এলাকায় ভ্রমণ করতে ভয় পাচ্ছেন। ফলে ভারত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এই জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ করার ওপর জোরালো বক্তব্য রেখে বিশ্ব সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
(৫) পার্শ্ববর্তী বৃহৎ রাষ্ট্র চীন কর্তৃক নতুন নতুন নদীবাঁধ নির্মাণের ফলে ভারতের উত্তরপূর্বের রাজ্য অরুণাচল ও আসাম তীব্র জল সঙ্কটের সম্মুখীন। এর আশু সমাধান সহ বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের আহ্বান জানান।
(৬) জলবায়ু সমস্যার ওপর আলোকপাত করে তিনি বলেছেন, নিত্যনতুন কলকারখানা ও অত্যধিক যানবাহনের ব্যবহার বিশ্বের আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করছে। ফলে আবহাওয়া ক্রমশ দূষিত হচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, গ্রিন হাউস এ্যাফেক্ট, বনাঞ্চল ধ্বংস ইত্যাদি আবহাওয়ায় বিরাট পরিবর্তন সাধন করছে। অচিরে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে মানব সম্পদ বিলুপ্ত হতে পারে।
(৭) মেডিক্যাল টেকনোলজির উপর বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, সম্প্রতি কোভিড-১৯-এর ব্যাপক সংক্রমণ বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সকলকে সহাবস্থান করতে হবে। তাই নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সামিল করতে হবে, যাতে মানব সম্পদ আরও উন্নত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াতে পারে।
(৮) শিক্ষার ক্ষেত্রেও সারা বিশ্বকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রকৃত শিক্ষার দ্বারাই বন্ধুত্বপূর্ণ বাতাবরণ গড়ে উঠতে পারে। ফলে একে অপরের মধ্যে হানাহানি ও যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে।
(৯) পরিবেশকে সংরক্ষিত রাখতে হবে। আমাদের ভুলেই আজ বরফ গলে যাচ্ছে, কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টি। দৈনিক উষ্ণতার গড় ক্রমবর্ধমান। যার পরিণতিতে মানব সভ্যতা আজ ধ্বংসের মুখে। সুতরাং বিশ্বের সবগুলো রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সাধারণ সভা তাঁর এই প্রস্তাবনা সমূহের ভূয়সী প্রশংসা করে। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের বিদেশ মন্ত্রকে এই প্রস্তাব সমূহ প্রেরণের আশ্বাস দেওয়া হয়। জড়িত রাষ্ট্র সমূহের বিদেশ মন্ত্রক ইউএনও’র নীতি নির্দেশিকা অনুযায়ী সমাধানের রাস্তা খুঁজে নেবে বলে প্রস্তাব গৃহীত হয়। দুবাইতে অবস্থানকালে নৃপেন্দ্র দাস আরবের রাজার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন এবং ১৯০টি দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে আলাদাভাবেও আলোচনায় মিলিত হয়। বিশেষ করে জন্মভূমি শনবিলকেও তিনি এই বিশ্ব সম্মেলনে পরিচয় করিয়ে দিতে সমর্থ হন। দক্ষিণ আফ্রিকা, আমেরিকা সহ অন্যান্য অনেক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা মঞ্চে তাঁর সঙ্গে শনবিলের ব্যানার তুলে ধরেন।
এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল হার্ট অব দুবাই বলে খ্যাত মনোরম অট্টালিকা “ডাবল ট্রি হিলটন” হলে। উল্লেখ্য, এ বছরই আগস্টের ২১-২৮ তারিখ পর্যন্ত মালয়েশিয়া এবং অক্টোবরের ১২-১৮ তারিখ পর্যন্ত তুর্কীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন শনবিলের ছেলে নৃপেন্দ্র দাস। এর প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। খুব শীঘ্রই আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা এবং কেন্দ্র সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে দেখা করে তিনি তাঁর দুবাই সম্মেলনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন।