Barak UpdatesCultureBreaking News

নাটক ‘দায়বদ্ধ’: মানবিক সম্পর্কের এক ম্যানিফেস্টো, লিখেছেন দীপক সেনগুপ্ত

১ জানুয়ারি : দ্বিতীয়বার মঞ্চস্থ হল নাটক ‘দায়বদ্ধ’। নাটক শুরুর আগে বঙ্গভবনের সামনে ভিড়। টিকিট বিক্রেতা একা ভিড় সামলাতে পারছিলেন না। টিকিট দিয়ে স্থানীয় নাটক! আশ্চর্য হওয়ার মতই ঘটনা, কিন্তু এটা বাস্তব। গত ২৯ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে কোন আসন খালি পড়ে নেই। প্রায় সব প্রজন্মের নাট্যমোদি দর্শক উপস্থিত। নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পর্দা উঠল। একে একে সব অভিনেতা অভিনেত্রীদের পরিচয় করিয়ে দিলেন নির্দেশক অভিনেতা সুব্রত রায় (শম্ভু)। সূচনায় পরিচয় পর্বের অভিনবত্ব একটা উজ্বল মাইলফলক হয়ে রইল। প্রথার বাইরে যেতে অনভ্যস্ত মন এই পরিচয় পর্বকে কতটা মেনে নিতে পেরেছে জানি না। তবে নির্ধারিত সময়ে নাটক শুরু করতে দায়বদ্ধ নাট্যদল নিজেদের আন্তরিকতা প্রমাণ করেছে।

মঞ্চসজ্জায় যখন সুজিত পালের নাম উচ্চারিত হয় তখন মঞ্চের নান্দনিকতা ও শিল্পবোধের কোনও ঘাটতি থাকবে না, এটা নিয়ে ন্যূনতম সন্দেহ থাকে না। নিখুঁত কারুকার্যময় শিল্পবোধ সম্পন্ন নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ ত্রিমাত্রিক মঞ্চ নাটকের গুণমানের আভাস দিল।  আলোর পরিমিত ব্যবহার ও আবহের যথাযথ প্রক্ষেপণে শুরুতেই প্রসেনিয়ামের বেড়াজাল ভেঙে দর্শকরা চরিত্রদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠলেন। আলোতে দেবজ্যোতি রায় এবং মঞ্চের দায়িত্বে থাকা সুজিত পাল ও রাজকুমার রায়কে একশ শতাংশ মার্ক দিয়েই নাটকে প্রবেশ করলাম।

ত্রিমাত্রিক মঞ্চের নায়ক গগনের ঘর একপাশে, অন্যপাশে নায়িকা সীতার রান্নাঘর, সামনে প্রশস্ত উঠোন। নাটকের শুরুতে দেখা গেল, বাবা গগনের সঙ্গে কলেজছাত্রী মেয়ে ঝিনির সাবলীল কথোপকথন ও আবেগময় খুনসুটি। অন্যপাশে সীতার ব্যস্ততা। বাবা মেয়ের সম্পর্কের মাধুর্যময় ঝলমলে আলোয় সীতার বিরক্তিকর অভিব্যক্তি নাটককে ভিন্নমাত্রা দান করেছে। কেননা দুই পরস্পর বিরোধী ক্রিয়াশীল ঘটনা নাটককে প্রাণবন্ত করেছে। নাটক যত এগিয়ে যায়, পরতে পরতে জমে থাকা রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে। গগন একজন লরি চালক। রোজগারের প্রয়োজনে দূরদূরান্তে যেতে হয়। লরিচালকের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, দর্শনশাস্ত্র নিয়ে পড়া কলেজছাত্রী ঝিনির কাছে উপস্থাপন করে গগন। ঝিনিও সমান আগ্রহ নিয়ে শোনে। অন্যদিকে সীতার বিরক্তিভাজন অভিব্যক্তিতে নিস্পন্দ চলাফেরা। এই বৈপরীত্য নিয়ে নাটক টানটান উত্তেজনা বজায় রেখে এগিয়ে চলে।

গগন চরিত্রে দাপুটে অভিনেতা সুব্রত নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। ঝিনি চরিত্রে তানিয়া দাস সমান দক্ষতা নিয়ে বাবা-মেয়ের সম্পর্ককে মাধুর্য দান করেছেন। লরির খালাসি জীবন চরিত্রে সৌম্যায়ন রায় অসাধারণ দক্ষতা নিয়ে অভিনয় করেছেন। দেবু চরিত্রে অনির্বাণ রায় খুব স্মার্ট অভিনয় করে নিজের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। লরিচালক গগন ১৮ বছর আগে শহরের প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার গিন্নী ও তার তিন বছরের মেয়েকে উদ্ধার করে নিজের বাড়ি নিয়ে আসে। গগন কোনওদিনই সীতাকে পাওয়ার মতো করে পায়নি। এক ছাদের নিচে থাকলেও দেহমনের মিলনের কোনও ইঙ্গিত নেই। অনেক দর্শকের কাছে বিষয়টা গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। তাঁদের মনে করিয়ে দিই, শরৎচন্দ্রের ‘শেষপ্রশ্ন’ উপন্যাসের রাজেন ও কমলের চরিত্রের কথা। একঘরে রাত কাটিয়েও কমল রাজেনের কোনও দৈহিক মিলন হয় না। রিপুর তাড়নায় দৈহিক মিলনে চরিত্র কালিমালিপ্ত হত, কেননা রিপুকে জয় করার মতো শক্ত মনের অভাব ফুটে উঠত এবং চরিত্রের উজ্বলতা হ্রাস পেত।

জীবনযুদ্ধে পরাজিত সীতার মন বিষিয়ে গিয়েছে, আর বিষানো মনে রিপুর প্রতি বিবমিষাবোধ থাকাটাই স্বাভাবিক। গগন কিন্তু রসেবশে আছে। শুধু মদ্যপই নয় নারী আসক্তিও প্রবল। পতিতালয়ে নিত্য যাওয়া-আসা করা গগন কিন্তু সীতার দিকে খারাপ চোখে দৃষ্টি দেয়নি। তার একটাই কারণ, ঝিনির প্রতি আন্তরিক বাৎসল্য। নৈর্ব্যক্তিক পিতৃত্বের বাৎসল্য যেমন দেখেছিলাম শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রায় মহর্ষি কণ্ব মুণির মধ্যে, গগনের মধ্যে যেমন তারই প্রতিচ্ছবি দেখলাম।

নাটকের ক্লাইম্যাক্স শুরু হয় দেবু চরিত্রকে নিয়ে। দেবু ঝিনিকে বিয়ে করবে এমনই ইচ্ছা মা সীতার। কিন্তু একটা সরকারি চাকরির জন্য দেবুর প্রয়োজন দেড় লক্ষ টাকা, যার মধ্যে এক লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়ার জন্য গগনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। গগন এক লক্ষ টাকা ঝিনিকে বিয়ে করার শর্তে আপত্তি, অন্যথায় এক লক্ষ কেন, আরও বেশি দিতে গগন প্রস্তুত। গগনের মূল্যবোধের উঁচু মাত্রাকে অনুধাবন করতে না পেরে অত্যন্ত কদর্য, কুৎসিত ইঙ্গিতে বাবা মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করে। গগন মানসিক আঘাতে ভেঙ্গে পড়ে উন্মাদের মতো আচরণ করে। এই সময়ে ঝিনির জানতে পারে যে, গগন তার জন্মদাতা বাবা নয়।

নাট্যকার চন্দন সেনের লেখা নাটক এখানে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল। প্রথম কথা, তিন বছরের মেয়ের স্মৃতিতে কিছু থাকবে না, মেনে নিতে কষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত, মা-বাবার অস্বাভাবিক সম্পর্ক ২১ বছরের মেয়ের মনে কোনও রেখাপাত করল না, মেনে নেওয়া যায় না। ঝিনি ওর জন্মরহস্যের কথা জানতে পেরে মূর্ছা যায় এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করে।  ইতিমধ্যে দেবুও তাকে টাকা দেওয়া নিয়েই অশান্তি বুঝতে পেরে টাকা ফেরত দিতে এলে সীতা টাকা নেয় না। দেবুও টাকা নিয়ে চলে যায় ফেরত না দিয়ে।

নাট্যকার বা নির্দেশক ইচ্ছে করলে যত্ন নিয়ে দেবু চরিত্রকে উপস্থাপন করতে পারতেন। দেবু যদি টাকাটা ফেরত দিয়ে যেত, তবে চরিত্র অনেক উজ্বল হত। কেননা তখন ঝিনির চিকিৎসার্থে অনেক টাকার প্রয়োজন এবং এই টাকার ব্যবস্থা করতে গগন নিজের সাধের লরি এমনকি বসতবাড়ি বিক্রি করার চেষ্টা করছে, তখন সব জেনে টাকাটা ঘুরিয়ে নেওয়ার মধ্যে চরিত্রটাই শুধু নষ্ট হয় না, ঝিনির বিশ্বাস ও প্রেম কলঙ্কিত হয়।

এদিকে পাড়ার মানুষ জেনে যায় যে, গগন দু’জন অবিবাহিত মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে থাকে। শুরু হয় কুৎসা রটানো এবং এই সূত্র ধরেই শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক পাড়ার প্রতিনিধিত্ব করে এসে তাদের অন্যত্র চলে যেতে বলেন। প্রবীণ শিক্ষকের চরিত্রে বিভাস রায় খুব ভালো অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে শারীরিক ভাষা প্রকাশে অসাধারণ পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। ইতিমধ্যে সীতা গগনের মনের পরিচয় পেয়ে যায়, বুঝতে পারে নির্লোভ গগনের মনে ঝিনির প্রতি পবিত্র বাৎসল্যের মধ্যে ছিটেফোঁটা অন্যায় নেই। সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধকে প্রত্যাহ্বান করে সীতার দৃপ্ত ঘোষণা, তারা কোথাও যাচ্ছে না। গগনকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে টেনে নেয়।

এখানেই নাটক শেষ। শেষ হল কি? না, নতুন প্রশ্নের জন্ম দিল মাত্র। অনাত্মীয় মানবিক সম্পর্কের ম্যানিফেস্টো রচনা করল। জীবন চরিত্রে সৌম্যায়নের প্রশংসা আরও একবার উল্লেখ করতেই হয়। সীতা চরিত্রে রুমি রায়ের চোখে মুখে বিরক্তির অভিব্যক্তিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্নাসিকতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা এবং পরবর্তীতে গগনের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশের বৈপরীত্য ফুটিয়ে তুলতে একশ’ শতাংশ সফল।

সঙ্গীত পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সুদীপ্ত চক্রবর্তী নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। রূপসজ্জার ক্ষেত্রে বিশ্বনাথ সমাজপতিকেও একশ’ শতাংশ দেওয়া যায়। তবে সীতার পোশাকের পরিপাটির মধ্যে বৈচিত্র্য আনলেই বোধহয় ভালো লাগত। গগন চরিত্র উপস্থাপনে সুব্রত রায় নিজের অভিনয় প্রতিভাকে আরও একবার চিনিয়ে দিলেন। আর নির্দেশনার ক্ষেত্রে দক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছেন। নাটকের টানটান গতি, পরতে পরতে রহস্যে মোড়ে নাটক উপস্থাপনার কৃতিত্ব নির্দেশকের একক প্রাপ্য। ‘দায়বদ্ধ’ যতটা নাট্যকার চন্দন সেনের, ততটাই নির্দেশক সুব্রত রায়ের।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker