Tourism
জম্মু-কাশ্মীর ভ্রমণ ডায়েরী
জম্মু-কাশ্মীর ভ্রমণ ডায়েরী
সনঃ ২০১৩ মাস অক্টোবর
সন্দীপ দাস:
ন্যাশনেল হাইওয়ে, শিলচর-১২
শৈশব থেকেই মনের গহীনে কাশ্মীর ভ্রমণের স্বপ্ন লালিত হচ্ছিল। যদিও শান্তস্নিগ্ধ শুভ্র সেই উপত্যকায় বারুদের গন্ধ আর গোলাগুলিতে যৌবনের দিনগুলির সেই আখাঙ্খা প্রায় ঢাকাই পরে গিয়েছিলো। কিন্তু বছর দুই তিন থেকে উপত্যকায় শান্তি ফিরে আসতেই আবার নতুন করে স্বপ্ন দানা বাধতে শুরু করলে, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে শিলচর থেকে কলকাতা হয়ে পৌছে গেলাম কাশ্মীরের পদতল জম্মু রেল ষ্টেশনে, জম্মু তখন সবে মাত্র আড়মোড়া দিয়ে ঘুম ভেঙ্গে জাগবে জাগবে করছে। স্টেশনের বাইরে বেরোতেই মধ্য অক্টোবরের শেষ রাত্রিরের আলতো হিমেল ছোয়ায় অজানা এক ভালোলাগার অনুভুতি জাগিয়ে দিচ্ছিল। সাত থেকে পঞ্চাশ বৎসর বয়সের আমরা বাইশজনের একটি বিশাল দল পূর্বনির্ধারিত দুইটি গাড়ী নিয়ে জম্মুকে পেছনে রেখে যাত্রা শুরু করলাম স্বপ্নের কাশ্মীরকে দুচোখ ভরে দেখে নিতে।
দিন ১
ভোর ৭টায় (এখানে এটা জেনে রাখা ভালো, ঐ অঞ্চল সূর্যের সময়ের হিসেবে আমাদের এতদঞ্চল থেকে প্রায় দেড় ঘন্টা পিছিয়ে আছে।) গাড়ী করে জম্মুরই এক সুউচ্চ পাহাড় পাটনিটপ এর উদ্দ্যেশে যাত্রা শুরু করে আমাদের জম্মু-কাশ্মীর ভ্রমন শুরু হলো। পাটনিটপ জায়গাটা অধিকাংশেরই অচেনা, জায়গাটা কিন্তু খুবই সুন্দর। হাজারো পাইন গাছের মধ্যে ছবির মতো ছোট বড় হোটেলগুলি পর্যটকদের জন্যে নিরালায় এক রাত্রি কাটিয়ে আসার অপেক্ষায় সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা আছে। আগেই জেনে গিয়েছিলাম যে পাটনিটপ শ্রীনগর বা পহেলগাম থেকেও উচু তথা ঠাণ্ডা জায়গা। জনবসতিহীন পাটনিটপের অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে মেঘের আনাগোনা থাকা পরিস্কার নীল আকাশ এবং তৎসঙ্গের নিস্তব্ধতাই পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ।
চারিদিকে রাশি রাশি পাইন গাছের মধ্য দিয়ে দুপুর ১২টা নাগাদ পৌছে গেলাম পূর্বনার্ধারিত হোটেলে। অক্টোবরের মাঝামাঝি বলে এই সময় দিনের তাপমাত্রা বেশ ভালোই লাগছিল। হোটেলে পৌছে চটপট স্নানাদি সেরে সেই হোটেলেই দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সেরে বেরিয়ে গেলাম আরো উচুস্থানে অবস্থিত প্রায় এক কিলোমিটার দুরের নাগ মন্দিরে।মন্দির দর্শন শেষ করে সঙ্গের কেহ কেহ একফাকে সেখানে টুকটাক কেনাকাঁটা সেরে নিলেন।তারপর সেখান থেকে চলে গেলাম অনতিদূরের এক বেশ বড়সড় পার্কে।
বিশাল পার্কের অসংখ্য সাজানো গুছানো গাছের ফাঁকে ফাঁকে ম্লান সূর্যের আলোয় অতি মনোরম পরিবেশে সবাই যেন ফিরে গেছেন নিজেদের ছোটবেলায়। শান্ত সেই পার্কের মধ্যে হৈহুল্লোর করে কিভাবে যে সময় চলে গেল তা বুঝবার আগেই দলের প্রধানের ডাকে ফিরে চললাম গাড়ীর দিকে। সেখান থেকে চলে গেলাম আর একটু দুরের শিশু উদ্যানে। দলের ছোটরা সেখানে বেশ কিছু সময় নিজেদের মতো কাটিয়ে নেওয়ার পর যখন পশ্চিমাকাশের দিগন্তে পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের সোনালী আভা জানান দিচ্ছিলো যে সন্ধ্যা আসন্ন, তখন সবাই ফিরে চললাম হোটেলের উদ্দ্যেশে। পাটনিটপের প্রধান আকর্ষণ টের পেলাম যখন সন্ধ্যে হতেই হিমেল হাওয়া বইতে শুরু হলো, সন্ধ্যা আটটা নাগাদ বাইরের তাপমাত্রা বেশ কমে এলে তা উপভোগ করতে ধোয়া উঠা কফি আর গরম পকৌড়া নিয়ে ঝুলন্ত বারান্দায় দুইজন বসে পরলাম। কিন্তু সেটা বেশী সময় সম্ভব হলো না, কারণ ৬-৭ ডিগ্রীর শীতল হালকা ঝড়ো হাওয়া গরম কফিকে মুহূর্তে ঠান্ডা করে দিলে টের পেলাম ঠান্ডা কাকে বলে, ঝড়ো হাওয়া গরম কাপড় ভেদ করে হাঁড়ে প্রায় কাঁপুনি ধরে দিলে তাড়াতাড়ি উষ্ণ বিছানায় আশ্রয় নিলাম। হোটেলের দেয়ারগুলি কাঠের থাকায় ভেতরের কোঠাগুলো বেশ আরামদায়ক অনুভুত হচ্ছিল। রাত্রি দশটা নাগাদ হোটেলের সবচেয়ে বড় ঘরে সবাই মিলে হৈচৈ করে রাতের খাওয়া শেষ করে যে যার ঘরে শুয়ে পরলাম, কারণ পরেরদিন ভোর সাতটায় বেরিয়ে পরতে হবে পহেলগাম এর উদ্দ্যেশে।
দিন-২
সকাল পৌনে সাতটা নাগাদ সবাই গরম জলে স্নানাদি শেষ করে পহেলগাম যাওয়ার জন্য তৈয়ারী হয়ে খেয়াল হলো গাড়ীর ড্রাইভারকে তো পাটনিটপ ছেড়ে যাওয়ার সময়ের ব্যাপারে জানানোই হয়নি, সাথে সাথে ফোন করে জানালেও গাড়ী ছাড়তে ছাড়তে ঘড়িতে প্রায় সাড়ে সাতটা।মাত্র সেই পয়তাল্লিশ মিনিট সময়টুকুও তখন যেন শেষই হতে চাইছিলো না, কেনোনা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কাশ্মীর ভ্যালিতে ঢুকে পরার জন্য। যাইহোক, সেই সময়টুকু কাটানোর উদ্দেশ্যে সবাই আশপাশে ঘুরে দেখতে গিয়ে অজস্র বানরের মুখোমুখি হলাম। সকালের ঘন নীল আকাশের নিচে গাঢ় সবুজ পাইনগাছের মধ্যে মৃদুলয়ে বয়ে চলা বাতাসের সরসর শব্দে আর আরামদায়ক ঠাণ্ডায় ছোট বড় বিভিন্ন বয়সী বানরের কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতে কিভাবে যে সময়টুকু চলে গেলো বুঝতেই পারলাম না। যাইহোক, কিছু সময়ের মধ্যেই ঝিলম নদীকে বাঁপাশে রেখে গাড়ী যতই এগোতে লাগলো ততই আশপাশের দৃশ্য বদলাতে শুরু করলো, দূরদূরান্ত পর্যন্ত শুধুই উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি, তার মধ্যে বয়ে চলা ঝিলমের অপরুপ দৃশ্যগুলো যেন শিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা কোনো ছবি, কখনো এক পাশে রুক্ষ পাথরের পাহাড় তো কখনো পাইনের জংগল আর তার মধ্যে আমাদের ভারতকে সুরক্ষিত রাখতে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে অতন্দ্র পাহারারত ভারতীয় সৈনিক দল।
সকাল ৯টা নাগাদ গাড়ী এক ধাবার সামনে দাঁড়ালে সবাই গাড়ী থেকে নেমে ধাবার ভেতরে ঢুকতেই কেউ একজন হিন্দিতে বললো, ধাবার পেছনে চলে যান ফ্রেশ হয়ে পেছনের দৃশ্য উপভোগ করুন। সেকথা শুনে সবাই পেছনে যেতেই অনতিদূরের একটি জলপূর্ণ সুবিশাল ড্যাম এবং তার আশপাশ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম, সেখানে কি যে ফটো উঠার ধুম। যাইহোক সেই ধাবায় এক অনভ্যস্ত খাওয়ার তৈয়ারী দেখে তো সবার চোখ কপালে, এক ডিশ ভর্তি ধোয়া উঠা ভাতের সাথে কাশ্মীরের বিশেষ সুস্বাদু রাজমার ডাল এবং তার সাথে কম করেও ১৫০ – ২০০ মিঃ লিঃ খাটী ঘি। আমাদের মধ্যে যারা খাদ্যরসিক অথচ বয়সের কারণে যাদের ঘি খাওয়া বারণ তাদের একটা কথাই বার বার মনে আসছিলো যে, কম বয়সে যখন খাওয়াদাওয়াতে কোনো বারন থাকেনা তখনই দেশবিদেশ ঘুরে নেওয়াটাই উচিৎ। ছোটোরা তারিয়ে তারিয়ে সেই সুস্বাদু ঘিয়ের বন্যায় ভেসে যাওয়া প্লেট শেষ করলেও, আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো সামান্য ঘি এর সাথে ভাত খেয়ে আবার গাড়ীতে উঠে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছন্দপতন! সারি সারি দিয়ে দাঁড়ানো গাড়ীর পেছনে আমাদের গাড়ী দাঁড়িয়ে পরলো, ব্যাপার কি জানতে চেয়ে এটাই বুঝতে পারলাম দুর্ঘটনাহেতু একটি সেনা গাড়ী খাঁদে গড়িয়ে পরায় তা উপরে উঠানোর প্রয়াস চলছে, সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘন্টাদুয়েক এখানেই দাঁড়াতে হলো। তারপরে দুঘন্টা পর আবার পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ী ছুটতে শুরু করলেও মনটা খারাপ হয়ে গেলো, কারন হিসেব মতো যখন পহেলগামে পৌছব সেদিন আর কিছুই দেখতে পাওয়ার কথা নয়। যাইহোক, বেশ কিছু সময় পর পথে বাণিহাল এলাকা পার হওয়ার সময় আমাদের ভাগ্য ভাল থাকায় পাহাড়ের উপরে বাস রাস্তা থেকে শচারেক ফুট নীচে কাশ্মীরের বাণিহালের গুহা থেকে বেরিয়ে আসা উপচে পরা যাত্রী সমেত ট্রেন গুহার অনতিদূরে বাণিহাল ষ্টেশনে ঢুকতে দেখার সৌভাগ্য হয়ে গেলো, সৌভাগ্য বলার কারণ হল দৃশ্যপট এতোই মনোমুগ্ধকর ছিলো, যেন মনে হচ্ছিল কোনো সিনেমার শ্যুটিং দেখছি। ভাল লাগলো এটা দেখে যে বাণিহালের মতো চারিদিকে ধারণার বাইরে অতি সুউচ্চ পাহাড় থাকা অঞ্চলেও ট্রেন চলাচল করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখান থেকে আমাদের গাড়ী জম্মু ও কাশ্মীরের মধ্যেকার প্রাচীর হিসেবে খ্যাত সুবিশাল পীরপঞ্জাল পর্বতের পাদদেশে পৌছে গেলে আমরা উৎসুক হয়ে ছবি উঠাতে গেলে গাড়ীচালক বাধা দিয়ে বললো ভারতীয় সেনাবাহিনীর আদেশে এখানে ছবি উঠানো বারণ। এই পীরপঞ্জাল পর্বতমালাটি ভারতের হিমাচল প্রদেশ থেকে আজাদ কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত। অতি বিশাল এই পর্বতমালাটির মধ্যদিয়ে জওহর টানেল নামে খ্যাত ২৫৪৭মিঃ সুদীর্ঘ এবং যথেষ্ট চওড়া সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে গাড়ী পার হতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় লেগেছিলো, কিছুক্ষ্ণণ পর ছোট শহর অনন্তনাগে প্রবেশ করলাম এবং গাড়ীর ড্রাইভার জানালো এখান থেকে দুটি রাস্তার একটি শ্রীনগর চলে যায় আরেকটি পেহেলগাম চলে যায়, যাইহোক ডানদিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে বিকেল পাঁচটা নাগাদ পহেলগামের হোটেল পৌছে যাওয়ায় যেহেতু সন্ধ্যে নেমে আসার মাত্র ঘন্টা দেড়েক সময় ছিলো তাই আর সময় নষ্ট না করে আধঘন্টার মধ্যে তৈরী হয়ে স্থানীয় পার্কে ছুটে গেলাম। পার্কের দুই দিকে বরফে ঢাকা চুড়ো আর তার মধ্যে সুন্দর সাজানো গোছানো পার্কে কিছু সময় কাটাতে কাটাতেই সন্ধ্যে হয়ে আসায় সেদিনের মতো হোটেলে ফিরে চললাম।
দিন-৩
ভোর সাতটা নাগাদ পুত্রকে সাথে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পরলাম, সকালের হিমেল হাওয়ায় পহেলগামের প্রধান সড়কে একচক্কর ঘুরতে ভালোই লাগছিলো।
শহরটির মূল সড়কের একদিকে মনে হচ্ছিলো রাস্তাটি সোজা একটি পাহাড়ে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে যার চূড়া দেখতে হলে ঘাড় প্রায় কাত করে দেখতে হয়, অন্যদিকে রাস্তা দুরদূরান্ত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো, এবং তার শেষেও আর একটি পাহাড়। যাইহোক শহরের রাস্তায় ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে আমার পুত্রের সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছিলো তা হলো ফাঁকা পথে অসংখ্য ঘোড়ার ইতঃস্তত ঘুরে বেরানো।
ইতিমধ্যে সঙ্গের সবাই তৈরী হয়ে গেলে, সকালের ভরপেট প্রাতরাশ সেরে ৯টা নাগাদ দুটো সুমো গাড়ী করে পহেলগাম থেকে দুরের তিনটি দর্শনীয় স্থান দেখার উদ্দ্যেশে বেরিয়ে পরলাম। প্রথমেই গেলাম ৫কিঃ মিঃ দূরের অনিন্দ্য সুন্দর বেতাব ভ্যালিতে, টিকিট কেটে ভেতরে যেতেই প্রথমেই একই ধরণের সার সার গাছের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় গাইড জানালো ভারতের প্রাণপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের ব্যাট তৈরী হয় এই ধরণের গাছ অর্থাথ উইলো কাঠ থেকেই, ।
তারপর সেই জায়গা পেরিয়ে যাওয়ার পরই পৌছে গেলাম এক অনবদ্য বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, যার চারিদিকে পাইন গাছের সারি, পাহাড়ি নদী আর গগনভেদী পাহাড়ের মধ্যে সোনালী সূর্যকিরণে এক মায়াবী পরিবেশ গাইডের অঙ্গুলি নির্দেশে খাড়া পাহাড়ের উপর দিকে একটি গুহা দেখতে পেলাম যা নাকি মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবের অনন্ত যাত্রাপথের এক বিশ্রামস্থল, এখনো নাকি সেখানে পাণ্ডবদের ব্যবহৃত বাসন রয়ে গেছে। এই প্রান্তরেই নাকি সানিদেওল অভিনিত মিষ্টি প্রেমের ছায়াছবি বেতার ও যব তক হ্যায় জান ইত্যাদির দৃশ্যায়ন হয়েছিলো। এখানের পাহাড়ি নদীটি নাকি শেষনাগ থেকে উৎপত্তি তাই এটার জল হিন্দুদের জন্য পবিত্র।
যাইহোক হাতে সময় কম থাকায় অনিচ্ছাস্বত্তেও মিনিট পঞ্চাশেকের ভেতরে সেই স্থান ত্যাগ করে পরবর্ত্তী স্থান ১৫ কিঃমিঃ দূরত্বে স্থিত চন্দ্নওয়ারি এর উদ্দ্যেশে যাত্রা করলাম। চন্দরওয়ারির বিশেষত্ব হলো, অমরনাথের পদযাত্রা শুরু হয় এই স্থান থেকেই, এবং পাশে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীটির উৎপত্তি সেই অমরনাথ থেকে। সুমো গাড়ী থেকে নেমে কিছুদূর যেতেই একটি সিড়ি নজরে পরলো, গাইডকে অনুসরণ করে অমরনাথের সেই সিড়িতে পা দেওয়ার আগে দলের প্রায় প্রত্যেকেই বাবা অমরনাথের উদ্দেশ্যে সিড়িতে প্রনাম সেরে নিলেন, দুধের স্বাদ ঘোলে (ঘোল নয় ঘোলের ফোটা বলাই যুক্তিযুক্ত হবে) মেটানোর প্রয়াস আর কি। সেই পথের পাশাপাশি বয়ে চলা নদীর অপর পারে একটি পরিত্যক্ত বিশ্রামস্থলের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে গাইড জানালো ঐটি নাকি পঞ্চপাণ্ডবদের দ্বারা নির্মিত আরো একটি বসবাসের নিদর্শন। অতি উচ্চতা হেতু দলের অধিকাংশ সদস্যই আর এগোতে সাহস করলেন না, তাদেরকে সেখানেই রেখে আমরা দশ বারোজন আর একটু উপরে এগিয়ে গেলাম। সেখানে যেতে যেতে গাইড অতি উচ্চতায় দূরের চূড়ায় একটি গাছ দেখিয়ে বললো, সমুদ্রতল থেকে আঠারো হাজার ফুট উপরে অবস্থিত ঐ গাছের পাশ দিয়েই অমরনাথ যাত্রীদের এগিয়ে যেতে হয়, এবং ঐ জায়গাতেই নিম্নভূমি থেকে যাত্রীদের শেষ দেখতে পাওয়া যায় এবং যাত্রীরাও ঐখান থেকে শেষ জনবসতি দেখতে পান, তারপর থেকে জনমানবহীন পথে কষ্টনীয় স্বর্গীয় যাত্রা। এরপর গাইড সেই পাহাড়ের পূর্ব দিকে আরও একটি
পাহাড়ে সারি সারি হালকা হলদে রং এর গাছের দিকে দৃকপাত করে জানালো এই গাছের পাতাগুলোই হলো সেই ভূজপত্র যা কিনা প্রাচীন কাল থেকে প্রাক কাগজ যুগে লেখার জন্য ব্যবহৃত হতো। গাইড আরো উপরে যাওয়ার জন্য বললেও সময় কম থাকার জন্য সেটা আর হয়ে উঠলো না।
সেই জায়গার পাশেই নীচে অমরনাথ থেকে বয়ে আসা নদীর জল ছোওয়ার আখাঙ্খা নিয়ে অতি উৎসাহী মাত্র চারজন সদ্য যুবক যুবতীর সাথে একমাত্র মধ্যবয়সী আমি অনেক কসরৎ করে ছোট-বড় পাথরের চাঁইয়ের খাঁজে খাঁজে পা রেখে বিপদসঙ্কুল পথে ফুট ত্রিশেক নিচে নেমে গেলাম। কোটি কোটি মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগ মিশ্রিত নদীর অতি স্বচ্ছ ঠাণ্ডা জল চোখে মুখে দিয়ে এবং প্রাণ ভরে সেই মিষ্ট জল পান করে, ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে না হলেও, এক অন্যধরণের অনুভূতি হচ্ছিল। অমরনাথ থেকে বহমান সেই জলের স্রোতে আমরা যারা নীচে নেমেছিলাম তারা প্রত্যেকেই প্রাণ ভরে মাথায় ছুয়ে একজন ছাড়া বাদবাকী সবাই গাইডকে অনুসরণ করে উপরে উঠে এসে গেলাম, তারপর নীচে থেকে যাওয়া সেই একজন উপরে উঠার রাস্তা না পাওয়ায় তাকে রাস্তা দেখিয়ে আনতে গাইড যেভাবে পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে গেলো তা দেখে কূশ ছায়াছবির ঋত্বিক রোশনের পাহাড় বেয়ে অনায়াস উঠা নামার দৃশ্যকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এভাবে পাহাড় বেয়ে নিম্নমুখী বেগকে বজায় রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে যাওয়া সুদক্ষ লোক ছাড়া কার্যত অসম্ভব, কেননা একচুল পা ফশকালেই অগুন্তি ছোট-বড় পাথরে আঘাত পেয়ে মৃত্যু ঘটাও অসম্ভব নয়। অসাধারন চন্দনওয়ারী ছেড়ে মন যেতে না চাইলেও আরো ১৫কিঃমিঃ দুরত্বে আরু ওয়াইল্ড লাইফ স্যানচুয়ারী যাওয়ার জন্য গাড়ীতে উঠে বসতেই হলো।
আরু ভ্যালিতে যাওয়ার প্রধান উদ্দ্যেশ্য হলো গ্রামীণ কাশ্মীরিদের একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিমায় সাজানো একটি বর্ধিষ্ণু গ্রামকে নিজের চোখে একবার দেখে নেওয়া, এবং সেই জায়গাতে পৌছানোর পথে অত্যন্ত উচ্চতা থেকে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কাশ্মীর ভ্যালিকে একবার পাখীর চোখে দেখে নেওয়া। কিন্তু সেদিনই আমাদের শ্রীনগরের উদ্দ্যেশে রওয়ানা হতে হবে বলে, সেই কাশ্মীরি গ্রামের জনজীবনকেও উপভোগ করার মতো সময় একেবারেই ছিলো না, গাড়ীচালক থেকে জেনে নিলাম এই গ্রামে পর্যটকরা কাশ্মীরের বিভিন্ন জিনিষ কিনতে পারেন। শেষ পর্যন্ত পহেলগামের হোটেলে ১টা নাগাদ পৌঁছে তাড়াতাড়ি সেখানের পাট চুকিয়ে ২০ মিনিটের মধ্যেই শ্রীনগরের উদ্দ্যেশে বেরিয়ে পরলাম।
প্রধান সড়ক হয়ে শ্রীনগর যেতে হলে আবার অনেকটা ঘুরে অনন্তনাগ হয়ে যেতে হতো, কিন্তু গাড়ী চালক ফিরতি পথে কিছুদূর এসে ডানদিকের একটি সেতু হয়ে ভিন্ন পথ ধরে এগোতে লাগলো, সেই পথে গাড়ী চলাচলও কম ছিলো, প্রায় ঘন্টা খানেক চলার পর রাস্তার দুই ধারে আপেল বাগান নজরে পরতে লাগলো, সবাই গাছে ফলন্ত আপেল দেখে উত্তেজিত হয়ে পরেছিলাম, গাড়ী চালকের থেকে জেনেছিলাম যে বাগানে ঢুকে গাছ থেকেই পেড়ে আপেল খেতে পারবো, তাই আর তর সইছিলে না, কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি আপেল বাগানের সামনে গাড়ী দাঁড়ালে সবাই বাগানে ঢুকে যেই গাছে হাত দিয়েছি, বাগানের মালকিন এসে হাজির, জানালেন একটি আপেল পেড়ে খেতে ১০টাকা লাগবে। একটি আপেল ১০ টাকা শুনে তো ভিড়মি খাওয়ার জোগার, শেষ পর্যন্ত জানা গেলো বেশি নিলে দাম অনেক কম, কিন্তু একটি খেয়ে চলে গেলে ঐ ১০ টাকাই। শেষে কাশ্মীরের বিখ্যাত ‘আমরি’ আপেল দরদাম করে সাব্যস্ত হলো কেজি প্রতি ৫০ টাকা, এখানে জানিয়ে রাখি সাধারণ আপেল মাত্র ১৫ টাকা, তাও পর্যটকদের জন্য। যাইহোক, সব মিলিয়ে প্রায় ২০ কেজি আমরি আপেল কেনা হলো, কিন্তু সেগুলি আগেই পেড়ে রাখা ছিলো। তাই মনকে মানাতে সবাই গাছ থেকে পেড়েই খাওয়া শুরু করলাম, যদিও সেগুলো আমরি ছিলো না তবুও গাছ থেকে সরাসরি বলে কথা, অবশ্যই একটু বেশী দাম দিয়েই তাজা আপেল কিনে খেয়ে মনের আশ মিটিয়ে নিতে কেউই কার্পণ্য করিনি। কিন্তু তার স্বাদ আমরি আপেলের ধারেকাছেও গেলো না, কারন আমরি আপেলের সুগন্ধ দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে, সে হিসেবে তার স্বাদ কি হতে পারে তা অনুমান করতে কষ্ট হয়না। আধঘন্টা খানেক সেখানে কাটিয়ে আবার গন্তব্যের উদ্দ্যেশে রওয়ানা হলাম। শ্রীনগর পৌছা পর্যন্ত শুধুমাত্র বরফ ঢাকা সুউচ্চ শৃঙ্গ ছাড়া আর বিশেষ কিছুই দেখার ছিলো না। যাইহোক, ড্রাইভার-সাব আমাদের কথামতে বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ শ্রীনগরের ঢোকার মুখে একটি বিখ্যাত শুকনো ফলের দোকানের সামনে গাড়ী দাঁড়ালে সবাই নেমে পরলাম কিছু ফল কিনে নেওয়ার উদ্দ্যেশে। সেখান থেকে যার যার পছন্দমতো জিনিষ কিনে এক কাপ খাঁটি কেশরের চা খেয়ে শ্রীনগরে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় ৫টা, কিন্তু অস্বাভাবিক জ্যাম এর জন্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের ডাল লেকের অদূরের হোটেল অবধি পৌছতে পৌছতে প্রায় বিকেল ছয়টা। সেখানে পৌছেই তাড়াতাড়ি করে তৈরী হয়েও গাড়ী নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত ডাল লেকের পাড়ে পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো। সেদিন পূর্ণিমা হওয়া সত্বেও ডাললেকের নাম নিয়ে গাড়ী যেখানে দাঁড়িয়েছিলো (সম্ভবত, সম্ভবত ন্য নিশ্চয় সেখানের শিকারা-চালকদের সাথে আমাদের ড্রাইভার-বাবুর কোনো বোঝাপড়া আছে), আধো অন্ধকারে সেখান থেকে ডাললেককে ভুতুরে জায়গা বলে ঠাহর হচ্ছিলো, ফলে দলের অধিকাংশ সদস্যরাই শিকারা চড়ার সাহস বা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু আমার মন বলছিল এটা ডাললেক হতেই পারে না, সম্ভবত এখান থেকে ডাললেকে যেতে হবে, তাই সবাইকে শিকারা চড়ে ডাললেকে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করতে আরম্ভ করলাম, এও বললাম কেউ না গেলেও আমি পূর্ণিমায় ডাললেকে অবশ্যই শিকারা চড়তে যাবো, মিনিট পনেরোর যাওয়া না যাওয়া নিয়ে উত্তপ্ত বার্তালাপের পর সাথে আরো দুইজনের পরিবার পূর্ণিমায় ডাললেকে শিকারা চড়ার লোভ সামলাতে না পেরে তিনটি শিকারা ভাড়া করে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
সেই ভুতুরে জায়গা পেরিয়ে ডাললেকের প্রধান অংশে প্রবেশ করতেই কিছুক্ষণের জনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম, পূর্ণচন্দ্রের ছায়ায় জলে যেনো তরল সোনার ঢেউ, তারসাথে দুধারে রংবেরংএর বিদ্যুৎ বাতির ছায়ায় মনে হচ্ছিলো কোনো স্বপ্নপুরীতে প্রবেশ করেছি। তাড়াতাড়ি করে আমাদের অপেক্ষায় পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের ফোন করে এমন পরিবেশ উপভোগ করার জন্য শিকারা ভাড়া করে চলে আসতে বললাম। পরে জানতে পেরেছিলাম আমারা শিকারা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর বাকি সবাইও ততক্ষণে শিকারা নিয়ে রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন। ঘন্টাখানেক ডাললেকে শিকারা চড়ার পূর্ণ আনন্দ মনে নিয়ে সবাই মিলে তাড়াতাড়ি করে খাওয়াদাওয়া সেরে হোটেলে ফিরে চললাম, এবং দিল্লী ছাড়ার পর এই প্রথম এক বাঙালী হোটেলে তৃপ্তি করে সবাই মাছভাত খেতে পেয়েছিলাম।
দিন-৪
গাড়ী চালকের কথামতো গুলমার্গে যাওয়ার জন্য ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সবাই তৈরী হয়ে গেলাম, কিন্তু সেসময় হঠাৎ করে হোটেল মালিক এসে বললো আমাদের হোটেল রুম ছেড়ে দিতে হবে, কেননা আগে থেকে বুক করা এক দল সেদিনই সেই হোটেলে পৌছবে, আমরাতো অবাক, বললাম হোটেলতো আমরাও অনেক আগে বুক করেছি, শেষ পর্যন্ত জানা গেলো আমাদের ট্যুর অপারেটর আমাদের জন্য এই হোটেল শুধুমাত্র একদিনের জন্য এবং সেইদিন থেকে আমাদের জন্য আরেকটি হোটেলে বন্দোবস্ত করে রেখেছে, আসলে আমাদের ট্যুর এজেন্টের হাতে এই দুই হোটেল ছাড়া অন্য মাঝারি মানের হোটেল না থাকায় এভাবেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। যাইহোক সময় বাঁচানোর জন্য হোটেল মালিককে বলে একটি রুমে সব ব্যাগপত্তর রেখে গুলমার্গের উদ্দ্যেশে রওয়ানা হতে হতে প্রায় সাজে ছয়টা বেজেই গেলো। শুনশান রাস্তায় গাড়ী ছুটতে শুরু করলে টের পেলাম সকালের পরিশ্রমে পেটে ছুটোর ডন শুরু হয়ে গেছে, এরপরও প্রায় মিনিট পয়তাল্লিশেক চলার পর একটি ছোটো ধাবার সামনে গাড়ী দাঁড় করালে সবাই বেশ আয়েস করে সকালের আরামদায়ক রোদ্দুরে শরীর এলিয়ে বাইরে রাখা চেয়ারে বসে পরলাম।
ঘন্টা খানেক ধরে মনোরম পরিবেশে সেই ধাবায় সকালের প্রাতরাশ সেরে গুমমার্গে পৌছতে পৌছতে প্রায় নয়টা বেজে গেলো। গাড়ী যেখানে দাড়িয়েছিলো সেখানে নেমেই সামনে বিশাল খোলামেলা প্রান্তর, যেখানে একটি শিবমন্দির দেখিয়ে স্থানীয় দালালরা জানালো এখানেই নাকি সত্যম শিবম সুন্দরম ছবির টাইটেল সঙের দৃশ্যায়ন হয়েছিলো। বাঁদিকে তাকাতেই নজরে পরলো অত্যন্ত উঁচুতে বরফাচ্ছাদিত একটি পর্বতচূড়া, তখন ভাবতেও পারিনি একটু পরে আপাত দৃষ্টিতে অলঙ্ঘনীয় সেই চূড়াতেই পৌঁছে যেতে পারবো। এরপর দালালদের হাত থেকে কোনোরকমে ছাড়া পেয়ে হেঁটে হেঁটে পৌছে গেলাম প্রায় পৌনে এককিলোমিটার দূরের গন্ডোলার (রোপওয়ে) টিকিট কাউন্টারের সামনে। গুলমার্গের গন্ডোলাই হলো এখন পর্যন্ত বিশ্বের সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গে যাতায়তকারী গন্ডোলা বা রোপওয়ে। সেখানের এক গাইড (দালাল বলা যেতে পারে) এসে বললো আমরা চাইলে সে টিকিট করে দিতে পারে এবং উপরে যাওয়ার পর বিভিন্ন জায়গা দেখিয়ে দেবে, শেষ পর্য্যন্ত টিকিট ঘরের সামনে ভিড় দেখে ওকেই দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষন পর সবাই গন্ডোলাতে চড়ে বসলাম, এখানে দুটো ফেস এ পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হয়, প্রথমটি ৯ মিনিট লাগে, দ্বিতীয়টি ১৯ মিনিট লাগে। দুটো ফেস এর জন্য আলাদা করে টিকিট কাটতে হয়েছিলো। প্রথমটিতে বিশেষ কিছু দেখার না থাকলেও যত সময় সেখানে ছিলাম ভালোই লাগছিলো। চূড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে নীচে পেজা তুলার মতো টুকরো টুকরো বরফ নজরে আসছিলো।
তারপর চূড়ায় পৌঁছে গন্ডোলার দরজা খুলতেই বরফ ঠান্ডা হাওয়া যেনো সমুদ্রতল থেকে ১৩৪০০ ফুট উপরে উঠার জন্য সশরীরে এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে যাচ্ছিল। গায়ের গরম জামাকাপড়কে আটোসাটো করে সেই ঠান্ডাষ্ণ (ঠান্ডা+উষ্ণ, নতুন ব্যাকরণ বৈকি) অভ্যর্থনাকে উষ্ণতার সাথে গ্রহণ করলাম। সেখানে থেকে গাইডের কথামতো তাকাতেই পীরপঞ্জাল রেঞ্জের ফাঁক দিয়ে দুরের হিমালয়ান রেঞ্জের এক টুকরো নজরে আসছিলো। যত দূর দেখা যাচ্ছিল চারিদিকে শুধুই বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের ঢেউ, মনে হচ্ছিলো আমরা বোধহয় শ্বেতশুভ্র চাদরের উপর দাঁড়িয়ে আছি। সে এক অদ্ভুদ অনুভুতি, আমরা যে চূড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটাও ছিলো বিশালাকার পীরঞ্জাল রেঞ্জেরই একটি চূড়া। কিছুক্ষণ পর সেখানে এক জায়গায় জমে থাকা বরফের উপর অভিজ্ঞ লোকের সাহায্যে একটু স্কিয়িং করে মনের এই প্রায় অসম্ভব ইচ্ছাটাকে পূরণ করে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। অসম্ভব বলার কারণ হলো, শুধুমাত্র স্কি এর উপর নিজের পা দিয়ে দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞ লোকের পেছনে ধরে পঞ্চাশ ফুট গিয়ে ঘুরে আসাকে যদি স্কিয়িং বলা যায় তাহলে আমি তারামণ্ডলের আরামদায়ক গদিতে বসে মহাকাশ ভ্রমণও সেরে এসেছি বলতে পারবো। তবে ধরে ধরে হলেও সেই জায়গাও কিন্তু স্কিয়িং করতে বুকের পাটা থাকতে হবে, কেননা জায়গাটা ভীষণই ঢালু ছিলো, আর সেখান থেকে পা ফসকানো মানে, পাথরে ঠোক্কর খেতে খেতে শপাঁচেক নেমে যাওয়াটা আর যাইহোক ছেলেখেলা হতো না। এখানেও বালক-বালিকা, কিশোর-যুবতীদের সাথে শুধুমাত্র মধ্যবয়সী একমাত্র আমিই। গাইডের থেকে জানলাম এই বরফ সবেমাত্র দুই তিন আগে থাকে জমতে শুরু করেছে। তারপর ঘন্টাদুয়েক সেই পাহাড় চূড়ায় সময় কাটিয়ে সম্ভবত এ জীবনের মতো গুলমার্গকে শেষ সেলাম জানিয়ে মনের কোঠায় অমলিন স্মৃতি নিয়ে হোটেলে ফিরে চলা।
দিন-৫
ভোর সাড়ে ছয়টা নাগাদ তৈরী হয়ে আমরা বেরিয়ে পরলাম ৮৫ কিঃমিঃ দূরের সোনমার্গ এর উদ্দ্যেশে। সকাল ১০টা নাগাদ প্রাতরাশের জন্য একটি ধাবায় নেমে জনাকয়েক বেরিয়ে পরলাম পাশেই বহমান এক পাহাড়ি নদীর আশপাশে কিছু ছবি উঠে রেখে দেওয়ার জন্য। জায়গাটাকে খুবই মনোরম লাগছিলো।
নদীর সামনে দাঁড়াতেই উল্টোদিকে প্রায় পাশেই এত উচু সবুজ খাড়া পাহাড় আগে কখনো দেখেছি বলো মনে পরছে না, বাদিকে তাকালে নজরে আসছিলো আরও উচু উচু সবুজ পাহাড়ের সারি, ডানদিকে বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের ঢেউ, আর তারই মধ্যে কল কল শব্দে বয়ে যাওয়া অজানা কোনো পাহাড়ি নদীর বরফগলা জলের স্রোতে পা ডুবিয়ে ফস করে তাজা হয়ে যাওয়া আর পাশ দিয়ে ঘোড়াকে নিয়ে কাশ্মীরি মহিলাদের নদী পেরিয়ে সেই পাহাড়ের ফাঁকে অজানা কোনো পথে চলে যাওয়া দেখতে দেখতে কিভাবে সময় চলে গেলো তা বুঝবার আগেই প্রাতরাশের আহ্বান এসে গেলো।
সেখান থেকে সোনমার্গের অদূরে বাস স্টপেজে পৌছতে পৌছতে প্রায় ১২টা। গাড়ী থেকে নেমে দেখতে পেলাম কেউ ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তো কেউ ছোটো গাড়ী ভাড়া করে সোনমার্গের দিকে যাচ্ছে, আমরাও দুইটি ছোটো গাড়ী ভাড়া করে নিলাম। সোমমার্গে যাওয়ার আগে বিশেষ দর্শনীয় তিনটি জায়গা দেখার জন্য গাড়ি প্রথমেই গেলো ফিশপন্ড নামক একটি জায়গায় যেখানে একটি মোটামুটি একটি বাচ্চাদের জন্য পার্ক এবং একটি বেশ চওড়া নালা সদৃশ্য একটি আঁকাবাঁকা জলাভূমি যেখানে বিভিন্ন জাতের মাছ ঘুরে বেরাচ্ছে, সেখান থেকে চলে গেলাম শেষ রাস্তার মোড়ে অর্থাৎ যারপর আর কোনো রাস্তা নেই, জায়গাটা মন্দ নয় কিন্তু তিনটি বিশেষ জায়গার মধ্যে আর একটি কোন জায়গায় নিয়ে গেলো বুঝলাম না বা এই অধমের মোটা বুদ্ধিতে বিশেষ কিছুই নজরে পরলো না। যাইহোক, বাসস্ট্যান্ড থেকে সোনমার্গ যাওয়ার রাস্তাটা সরু এবং আঁকাবাঁকা এবং ক্রমশ উপরের দিকে উঠে চলে যেতে যেতে দেখতে পেলাম অমিতাভ বচ্চন অভিনীত সত্যে পে সত্যা ছবির সাত ভাইয়ের সেই ঘরের শুধুমাত্র নীচের অংশটুকুই এখনো রয়ে গিয়েছে, আর একটু এগিয়ে রাম তৈরী গঙ্গা মইলির পাহাড়ি নদীতে গানের সেই পটভূমি, তারপর শেষ পর্য্যন্ত সোনমার্গের পাদদেশে, মনে হলো সম্ভবত এমন জায়গার দেখার আশায় মানুষ হাজার কষ্ট করেও অজানার উদ্দ্যেশে বেরিয়ে পরে, আর এটাই সেই জায়গা যেখানে হাজারো সবুজ পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে প্রবাহিত অতি নির্মল বাতাস, ধূলিহীন পরিষ্কার নীল আকাশ আর সাদা বরফে ঢাকা অগুন্তি পাহাড় এবং তার ফাঁকে ফাঁকে পেজা তুলার মতো ভেসে বেরানো মেঘের অপূর্ব সমাহারের মধ্যে পাহাড়ি নদীর কলতান যুগে যুগে মানুষকে অমোঘ টানে টেনে নিচ্ছে কিছুক্ষনের জন্য নিজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার জন্য। যখন প্রকৃতি তার নিজস্ব অকৃপণ হাতে কোনো জায়গার পটভূমি রচিত করে বোধহয় তখনই এরকম কোনো মায়াবী পরিবেশ তৈরী হয়। এখানে না আসলে কাশ্মীর ভ্রমণ অসম্পূর্ণই থেকে যেতো। প্রকৃতির সাথে সত্যি সত্যি একাত্ব হতে চাইলে এই জায়গার মতো কোনো জায়গাতেই যেতে হবে, নতুবা প্রকৃতির সাথে একাত্ব হওয়া অসম্ভব।
কিছুক্ষনের মধ্যেই অবাক হয়ে সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়াগুলিতে বরফের পরিমাণ দিগুণ হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে শুধুই প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া কি বা করার ছিলো? সেখানে অন্য কোনো কিছু করার মনই ছিলো না শুধুই ইতস্তত ঘুরে বেরানো আর ছবি উঠা ছাড়া। আড়াই ঘন্টা কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত ফিরতে হবে বলেই অনিচ্ছা সত্বেও আবার গাড়িতে উঠে বসে ফিরে চললাম বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে। তারপর সেখান থেকে চলে গেলাম মিনিট বিশেক দূরের ধাবায়, ভালো লাগলো খাটি নিরামিষ হোটেলের গরম গরম উপাদেয় খাবার খেয়ে। খাওয়া শেষে সেখানেই সঙ্গের মহিলারা পেয়ে গেলেন নিজেদের শখ পূরণের জন্য কাশ্মীরি পসরা নিয়ে তৈরী সেই হোটেলেরই আরেক অংশে থাকা একটি দোকান, সেখানে কেনাকাটা শেষ করতে করতে পড়ন্ত সূর্যের শীতল কিরণ আমাদের জন্য করুণ হয়ে উঠলে, ফিরে চললাম শহর অভিমুখে।
দিন-৬
ইতিমধ্যে শিলচর থেকে রওয়ানা হওয়ার ৮দিন অতিক্রান্ত, প্রায় প্রতিদিনই ভোরে উঠে সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পরা, ভালো-খারাপ রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা বাস রাস্তায় চলতে থাকা, দেরী করে ঘুমাতে যাওয়া আবার সাতসকালে উঠে যাওয়া, দৈনন্দিন জীবনে পরিশ্রমহীন দিন কাটানো মধ্য বয়সীরা আর শরীর দিয়ে পেরে উঠছিলেন না, তাই সবাই আজকে নিজের মতো করে একটু বেশী সময় পর্যন্ত বিছানায় গড়িয়ে নিলেন। নয়টা নাগাদ তৈরী হয়ে ভরপেট সেরে বেরিয়ে পরলাম শ্রীনগর ও তার আশপাশের বিশেষ দ্রষ্টব্যগুলি দেখে নেওয়ার উদ্দ্যেশে। ১০টা নাগাদ ডালগেটের রাস্তায় সুবিশাল ডাললেককে সারাক্ষণ বাদিকে রেখে দীর্ঘপথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বোটানিকেল গার্ডেনে (সম্ভবত এর আর একটি হলো টিউলিপ গার্ডেন)। শ্রীনগরে বেশ কয়েকটি পার্ক বা গার্ডেন আছে, যার মধ্যে বিভিন্ন ফুলে ফুলে শোভিত ও নানাবিধ গাছ থাকা বিশাল পার্ক সমেত হ্রদসদ্যৃশ্য ঝিলকে নিয়ে এই গার্ডেনটিকেই সম্ভবত শ্রীনগরে অবস্থিত সব গার্ডেনের মধ্যে রাণী-গার্ডেন আখ্যা দেওয়া ঠিক হবে। দীর্ঘ এক ঘন্টা সেই গার্ডেনের রূপ আস্বাদন করে আর ছবি উঠে পরবর্ত্তী দ্রষ্টব্যের উদ্দ্যেশে রওয়ানা হলাম। একটি সাধারণ উচ্চতার পাহাড়ের উপরে অবস্থিত একটি টিলাকে বিভিন্ন ফুল দিয়ে সাজিয়ে তৈরী মোঘল গার্ডেনেই অসময়ে কাশ্মীরের বিখ্যাত রডডেনড্রন ফুলের দেখা পেলাম।
গাইড থেকে জানতে পারলাম রডডেনড্রন ফুলের ফোটার প্রধান সময় হলো এপ্রিল-মে, যেসময় নাকি কাশ্মীর ভ্যালিকে দেখলে মনে হয় পুরো পাহাড়েই আগুন লেগেছে। যাইহোক, এই গার্ডেনের আর একটি নাম হলো চেশমাশাহী মতান্তরে চশমেশাহী গার্ডেন। চওড়া পাহাড়ের উপরে অবস্থিত একটি সাধারণ টিলার উপর থাকা এই গার্ডেনের সবচেয়ে উচুস্থানে অবস্থিত তিনদিক ঘেরা একটি ঘরের ভেতরে সাধারণ লোকের দৃষ্টির আড়ালে রাখা অজানা কোনো উৎস থেকে অবিশ্রান্ত জলের ধারা বেরিয়ে আসছিলো। অজানার (শক্তির) প্রতি চিরন্তন ভয় বা অভ্যাসবসত অধিকাংশ লোকই এটাকে পবিত্র জল ধরে নিয়ে কোনো অলৌকিক বা অজানা কোনো আর্শীবাদের আকাঙ্খায় মাথায় ছুয়ে একটু গলাঃধকরণ করে নিলেন, জানা নেই কার কি আর্শীবাদ প্রাপ্তি হলো কিন্তু যেটা জানা গেলো সেটা হলো শ্রীনগরে থাকাকালীন পণ্ডিত নেহেরু নাকি সর্ব্বদা এই জল পান করতেন। এক ঘন্টা সেখানে কাটিয়ে চললাম দুই কিলোমিটার দূরের পরবর্ত্তী দ্রষ্টব্য পরী মহলের উদ্দ্যেশে। অনেক উচু পাহাড়ে অবস্থিত ফুলে ফুলে সাজানো ছোটো সেই বাগান থেকে ডাললেকের অনেকটাই দেখা যায়, যদিও ডাললেকের বিশালতার দরুন অধিকাংশ অংশই দৃষ্টিশক্তির বাইরেই থেকে যায়। আধঘন্টা খানেক সেখানে থেকে আবার রওয়ানা হয়ে গেলাম নিষাদ ঘাটের উদ্দ্যেশে। সেখানের ঘাটে অপেক্ষারত অনেকগুলি যন্ত্রচালিত নৌকার মধ্যে দুটি নৌকাকে ভাড়া করে বিশ-পচিশ মিনিটের মধ্যে বিশাল এলাকা জুড়ে পদ্মপাতায় পরিপূর্ণ ডাললেকের অনেকটাই ভেতরে ঘুরে আসতে বেশ ভালোই লাগছিলো।
তবে পদ্মফুলে পরিপূর্ণ ডাললেকের মধ্যে নৌকাবিহার করা হলো না ভেবে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। যাইহোক নৌকাবিহার শেষে সেই ঘাটের উল্টোদিকে নিষাদ গার্ডেনে সময়ের অভাবে না গিয়ে চলে গেলাম শালিমার গার্ডেনের উদ্দ্যেশে। এই গার্ডেনের নাম সত্তর থেকে আশি দশকের সিনেমাপ্রেমীরা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সিনেমা জগৎ এর বাদশা অমিতাভ বচ্চনের অনেক ছায়াছবির দৃশ্যায়ন এই গার্ডেনেই হয়েছিলো। যতটুকু মনে আছে, সিলসিলা ছায়াছবিতে অমিতাভ ও রেখার বিখ্যাত যুগল গানের দৃশ্যায়নও এখানেই হয়েছিলো। ফলে টিকিট কেটে সেখানে ঢোকার পর আমরা মধ্যবয়সীরা নিজেদেরকে অমিতাভ বচ্চনের একেকজন প্রতিভু ভেবে মনের সুখে ফোটোসেশনে ব্যস্ত হয়ে পরাটা ছোটোদের জন্য হাস্যকর হলেও আমাদের কোনো পরোয়া ছিলো না।
জানাঅজানা হাজারো ফুল গাছের মধ্যে শুধু যে আমরা মধ্যবয়সীরাই হারিয়ে গিয়েছিলাম তাই নয়, ছোটোদেরকেও কংক্রিটের দেওয়ালের বাইরে রঙ্গীন ফুলের মধ্যে মুক্ত প্রজাপতির মতোই লাগছিলো। ঘন্টা দুয়েক পরে পেটে ছুচো তুমুল লম্ফঝম্ফ শুরু করলে সম্ভিত ফিরলো, ফিরে চললাম শ্রীনগরের উদ্দ্যেশে। আমাদের দলের একজন ঘোষনা করলেন আজকে উনি কাশ্মীরের বিখ্যাত পোলাও খাওয়াবেন, তাই সবাই সোৎসাহে চললাম শ্রীনগরের এক বিখ্যাত রেস্তোরায় কাশ্মীরি পোলাও খেতে। আমাদের এতদঞ্চলে কাশ্মীরি পোলাও বলে রেস্তোরায় যা চলছে তা নেহাৎই নামসর্বষ্য, তার সাথে সত্যিকারের কাশ্মীরি পোলাও এর রূপ ও স্বাদে দিন ও রাত্রির তফাৎ। যাইহোক সন্ধ্যে নাগাদ হোটেলে পৌছে জনাকয়েক সদস্যা গোট বেধে আশপাশের বাজারে বেরিয়ে পরলেন। রাত্রি দশটা নাগাদ বিছানায় যেতেই শেষ পর্য্যন্ত ছয়দিনের স্বপ্নের কাশ্মীর ভ্রমণের অন্ত হয়ে গেলো, কেননা পরের দিন রাত্রি সাড়ে রাত্রি সাড়ে নয়টায় জম্মু থেকে অমৃতসরের ট্রেন থাকায় গাড়ীচালক বলে রেখেছিলো পরের দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই শ্রীনগর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। হয়তো বা এ জীবনের মতো এটাই ছিলো শ্রীনগরের শেষ রাত্রিবাস, কেননা বিশাল ভারতবর্ষেরই অনেক জায়গা যে এখনো দেখার বাকি, আর জীবনটা তো ভীষণ ছোট।
–oo–