CultureBreaking News

লোকগানের ভেলায় চড়ে Folk-ইরার বর্ষপূর্তি, গাইলেন ওপার বাংলার ‘বান্নাভাই’, লিখেছেন অরিত্র ধর

২২ জুলাই : অবশেষে শেষ হল ফক-ইরা আয়োজিত তিনদিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার। মোট ৮০ জন প্রশিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে গত ১৮ জুলাই বিকেলে শিলচর সঙ্গীত বিদ্যালয়ে উদ্বোধন হয় কর্মশালার। প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে শিবিরের শুভ সূচনা করেন বাংলাদেশ থেকে আসা শিল্পী জামাল উদ্দিন হাসান বান্না, নন্দিনী চক্রবর্তী, শিল্পী সুজিত কুমার দাস, মধ্যসহর সাংস্কৃতিক সংস্থার অজয় চক্রবর্তী, ফক-ইরার উপদেষ্টা ভাস্কর দাস এবং জয়দীপ চক্রবর্তী।

এ দিন বক্তারা ভূয়সী প্রশংসা করেন ফক-ইরার এই কর্মযজ্ঞের। উদ্বোধনী রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন দুজন শিল্পী প্রতীতী শীল ও পৌলমী শীল। এরপরই প্রশিক্ষক জামাল উদ্দিন হাসান বান্নার হাতে মাইক্রোফোন তুলে দেন আয়োজকরা। লোকসঙ্গীতের ইতিহাস, লোকসংগীত কীভাবে মানুষকে আনন্দ দেয় ইত্যাদি তুলে ধরে শিল্পী উপস্থিত প্রশিক্ষার্থীদের মনে লোকসংগীতের ব্যাপারে আলাদা ভাললাগার জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করেন।

মূলত লোকগানের শিল্পী হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম ও রাধারমণ দত্তের গানের চর্চাতেই সীমিত ছিল এ কর্মশালা। তাই প্রথমদিনে মূলত এই তিন প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর ইতিহাস এবং তাঁদের গানের বিভিন্নতাতেই সীমিত থাকেন বান্না।

কর্মশালার দ্বিতীয় দিনে হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম এবং রাধারমণ দত্তের গানে গানে শিক্ষার্থীদের মন মাতিয়ে তোলেন শিল্পী বান্না। রসালো গল্পের ঝুরি আর কথায়-গানে বারবার শিক্ষার্থীরা কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছিলেন। শিশু থেকে প্রবীণ সব বয়সের প্রশিক্ষার্থীরাই ছিলেন কর্মশালায়। কিন্তু সময় যে কোথা দিয়ে কীভাবে কেটে যায় তা কোনওভাবেই বিন্দুমাত্র টের পাননি প্রশিক্ষার্থীরা।

ওইদিন সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সিলেট বিভাগীয় প্রতিনিধি শামসুল আলম সেলিম, মঞ্চের সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তী এবং মঞ্চের সদস্য অলক দাস। সবাই প্রাণভরে উপভোগ করতে থাকেন কর্মশালার।

তৃতীয় দিনে দুপুরবেলা মহড়ায় আবার সবকিছু ঝালিয়ে নেন শিল্পীরা। মূলতঃ তিনভাগে ভাগ করা হয় শিল্পীদের। গ্রুপ ‘এ’ তে ছিলেন কচিকাঁচারা, গ্রুপ ‘বি’ তে মধ্যবয়সীরা এবং বাকিদেরে গ্রুপ ‘সি’ তে রেখে গ্রুপ ভাগ করা হয়। হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে ধামাইল নাচের মহড়ার সঙ্গে শেষ হয় দুপুরের কর্মশালা। তবে কর্মশালার যবনিকা কিন্তু পড়ে রাতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

‘প্রাণের টানে মাটির গানে’ শীর্ষক শিরোনামে এ দিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই মঞ্চে বিশিষ্টজনদের সংবর্ধনা জানানো হয় সংস্থার পক্ষ থেকে। সম্মানপ্রাপকদের তালিকায় ছিলেন বাংলাদেশের লোকগানের শিল্পী জামাল উদ্দিন হাসান বান্না, বাংলাদেশের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তী, শিলচরের জনপ্রিয় শিল্পী বিধান লস্কর, শিল্পী সর্বাণী ভট্টাচার্য, শিলচরের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব শেখর দেবরায়, আয়োজক সংস্থার দুজন উপদেষ্টা ভাস্কর দাস ও জয়দীপ চক্রবর্তী।

তবে মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন একের পর এক লোকগানে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মন জয় করা শিল্পী বিধান লস্কর। তাঁকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করে টিম ফক-ইরা। ‘শিল্পী হয়ে জন্মাই’ গান গেয়ে তিনি এ দিন সম্মান তুলে নেন ফক-ইরার হাত থেকে।

সম্মাননা পর্ব শেষেই মঞ্চে দেখা দেয় খুদে শিল্পীরা। হলভর্তি দর্শকদের মন ভরে ওঠে ছোট ছোট শিল্পীদের সৌজন্যে। জামাল উদ্দিন হাসান বান্নার দ্বারা প্রশিক্ষণ শিবিরে শিখে আসা লোকগান পরিবেশনে মঞ্চ মাতায় তারা।

এরপরই স্টেজে আগমন হয় টিম ফক-ইরার শিল্পীদের। হাজার পরিশ্রম, হাড়ভাঙা খাটুনি সত্ত্বেও মঞ্চে টোটাল প্যাকড পারফরম্যান্স দেন শিল্পীরা। দেখে মনেই হয়নি এই কদিন ধরে এই শিল্পীরাই রাতজাগা পরিশ্রম করছেন নিজেদের অনুষ্ঠানকে সফল করে তুলতে। দুর্দান্ত মনোবলে এ দিনের পরিবেশনে নিশ্চিতভাবেই দর্শকদের মনে এক আলাদা জায়গা করে নেন শিল্পীরা।

তবে দর্শকদের বাড়তি পাওনা ছিল বাংলাদেশের আরেক শিল্পী গৌতম চক্রবর্তীর গান। এরপর কিশোরী শিল্পীদের পরিবেশনায় ছিল দ্বিতীয় কোরাস। কোরাসের রেশ ধরেই মঞ্চে শিল্পী বান্না গান ধরেন। মনমুগ্ধকর গানে হলভর্তি দর্শকের মন জয় করবার ত্রুটি রাখেননি প্রবীণ শিল্পী। তাঁর গানের ফাঁকে ফাঁকে নানা কথায় দর্শকদের মনে দাগ কাটেন ও তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দিয়ে যান শিলচরের বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব শেখর দেবরায়। ফক-ইরার এ প্রচেষ্টা নিশ্চিতভাবেই প্রশংসার দাবী রাখে।

গান শেষ হতেই ধামাইল গানে মুখরিত হয়ে ওঠে গান্ধীভবন চত্বর। প্রেক্ষাগৃহ প্রাঙ্গণে অবস্থানকারী শিশু থেকে প্রবীণ সবাই আনন্দে মুখর হয়ে ওঠেন। ভালবাসার টানে হৃদয়ে বারবার প্রতিধ্বনি তোলে মাটির গান। শুধুমাত্র মঞ্চে থাকা শিল্পীরাই নন পেছনে থাকা বাদ্যযন্ত্র শিল্পীদের মনেও লাগে আনন্দের ছোঁয়া। আনন্দে উদ্বেল হয়ে পড়েন সবাই। প্রাণ খুলে নিজেদের যন্ত্রে প্রয়োগ করেন নিজেদের প্রচেষ্টা।

শিলচরের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মত এই আয়োজনে আয়োজক সংস্থার পরিশ্রম এখানেই সার্থক। অনুষ্ঠান শেষে একরাশ তৃপ্তি নিয়েই বাড়ি ফেরেন দর্শকরা। সেল্ফি হোক কিংবা ছবি তুলে নিজেদের স্মৃতিকে সতেজ রাখার প্রচেষ্টা করেন উপস্থিত প্রায় প্রতিজনই। গানের শেষে প্রশিক্ষার্থীদের হাতে শংসাপত্র তুলে দেন প্রশিক্ষক শিল্পী জামাল উদ্দিন হাসান বান্না।

শিলচরের বাংলা লোকগানের দল ফক-ইরা যেভাবে লোকগানের ভেলায় চড়ে নিজেদের বর্ষপূর্তির শুভ সূচনা করল তাতে হলফ করে বলা যায় ভবিষ্যতে এ দল অনেকদূরই এগোবে। শিলচরের মাটিকে ভালবেসে, এ মাটির জন্যে হন্যে হয়েই তারা থাকুক জীবনভর। আমাদের ভালবাসার কালিকাদার স্বপ্ন হোক সার্থক। শিলচর স্বপ্ন দেখুক লোকগানে বেঁচে থাকবার।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker