Barak UpdatesCultureBreaking News
আন্তর্জালিক মঞ্চে মঞ্চস্থ নাটক ‘লাশ’- প্রযুক্তির সঙ্গে শিল্পের গাঁটছড়া, লিখেছেন দীপক সেনগুপ্ত
প্রযুক্তির সঙ্গে শিল্প আবহমান কাল থেকেই হাত ধরে চলছে । যেদিন ক্যামেরা আবিস্কৃত হল তখন চিত্রশিল্পীর দিন শেষ বলেই অনেকে ভেবেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে প্রযুক্তির প্রত্যাহ্বানকে মেনে নিয়ে চিত্রশিল্প অন্যধারায় এগিয়ে গেছে এবং নিজেকে বিকশিত করেছে। নাটকের ক্ষেত্রেও এই কথা বলা চলে। লোকায়ত আঙ্গিক থেকে সরে এসে প্রসেনিয়ামের যুগে প্রবেশ করে নাটক নিজেকে আধুনিক করে তুলেছিল । যদিও লোকায়ত আঙ্গিকের অন্তঃসলিলা স্রোত আজও বহমান , এবং সেই বহমান স্রোত শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত এবং বিকশিত। থার্ড থিয়েটার থেকে শুরু করে ইন্টিমেট থিয়েটার ইত্যাদি নানাবিধ শাখা প্রশাখায় নাটক এগিয়ে চলেছে প্রসেনিয়ামকে ভেঙ্গে দিয়ে। সিনেমা আসার পর অনেকেই ভেবেছিলেন নাটকের দিন শেষ৷ কিন্তু সেই আশঙ্কাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে নাটক বিষয় এবং আঙ্গিকের অভিনবত্বে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, এমনকি ঘরে ঘরে টিভি পৌঁছে যাওয়ার পরেও নাটকের কোনও ক্ষতি হয়নি৷ কেননা যারা জীবনের বাস্তব প্রতিফলন দেখতে চান তাঁরাই নাটকের দর্শক। নাটকের মধ্যে সমাজ, সংসার এবং বাস্তব জীবনের ঘনীভূত সংকটকে যারা অনুধাবন করতে চান তাঁরাই নাটকের চিরন্তন দর্শক। ‘নীলদর্পন’ হোক বা ‘নবান্ন’ নাটক সমাজের কথা বলে। সমাজ সংসারের প্রতি দায়বদ্ধ নাট্যব্যক্তিত্বরা সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে মানুষের সুখ, দুঃখের গল্প শুনিয়ে মানবতার জয়গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেন।
শতবর্ষের সুদীর্ঘ সময়কাল অতিক্রম করে শিলচরের নাট্যচর্চা এগিয়ে চলেছে দেশভাগের যন্ত্রণা, একাধিক ভাষা আন্দোলনের শহিদের রক্তে পিচ্ছিল পথ ধরে। এই যাত্রা পথে ‘এন আর সি’ নামক বিভীষিকা এসেছে, এসেছে কোভিড মহামারি এবং সর্বশেষ সংযোজন বিধ্বংসী বন্যা। বিশ্বায়নের বদান্যতায় এবং প্রযুক্তির বিপ্লব সমগ্র বিশ্বকে একই প্রেক্ষাগৃহের ছাদের নীচে নিয়ে এসেছে যেখানে মঞ্চের কুশীলবরা একদিকে থাকেন অন্যদিকে দর্শকাসনে সমগ্র বিশ্ব। আমরা দেখছি আন্তর্জালিক পরিসরে যেমন সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে ‘সুনামি’র জোয়ার এসেছে, নাটকও কিন্তু এতে পিছিয়ে নেই। পিছিয়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না, কেননা এই সুযোগকে কাজে লাগালে নাটক ভিন্ন মাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে, যেমন কোনও এক সময় হয়েছিল বেতার নাটকের ক্ষেত্রে। অনেকেই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করছেন, অনেকেই পারছেন না৷ আর যারা পারছেন না তাঁরা সময়ের কালবেলায় হারিয়ে যেতে পারেন, এমন সম্ভাবনাকে মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে যে কয়েকজন শিলচরের নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রাণাতিপাত পরিশ্রম করেন এবং যাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রশ্নাতীত, সুব্রত (শম্ভু) রায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। নাট্যকার অরিজিৎ আদিত্যের লেখা নাটক নিয়ে সুব্রত (শম্ভু) রায়ের পরিচালনায় তিন-তিনটি নাটক (এন আর সি ট্রিলজি) এই উপত্যকার নাট্য চর্চার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল প্রয়াস । আসলে আপাদমস্তক নাট্যব্যক্তিত্ব সুব্রত রায় (শম্ভু) মানুষটিই এই রকম যার কাছে মঞ্চ মানে ক্রিকেট মাঠ, যেখানে দেখা যায় গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের স্কোয়ারকাট বাউন্ডারি বা মহেন্দ্রসিং ধোনির স্ট্রেট ব্যাট ওভার বাউন্ডারি অথবা বিষেন সিং বেদীর স্পিন বোল। সুব্রত ( শম্ভু) রায়ের কাছে নাটকের মঞ্চ মানেই ফুটবল মাঠ যেখানে দেখা যায় শ্যাম থাপার ব্যাকভলি, পিটার থঙ্গরাজের গোলকিপিং বা মারাদোনার শৈল্পিক খেলা। ব্যক্তি স্তুতি হয়ে গেল? না, এটা এক আন্তরিক মূল্যায়ন।
আমরা মূল্যায়ন করতে জানি না বলেই পরাণ চক্রবর্তী, নীলু সেনগুপ্ত, পলু বিশ্বাস থেকে শুরু করে অনেকেই এমনকি দীলু ধর পর্যন্ত আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবে আছেন। উত্তর প্রজন্মের এমন কোনও গবেষক পাওয়া যাচ্ছে না যারা এই সব প্রতিথযশাদের আলোয় নিয়ে আসবেন এবং যথোচিত মূল্যায়ন করবেন। প্রতিথযশা নাট্যব্যক্তিত্ব নরেশ পালের কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করতে হয়৷ কেননা রূপম সংস্থার মত প্রতিষ্ঠান আছে বলেই তাঁর নাম উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। যারা জীবনসায়াহ্নে অথবা ইতিমধ্যে পরপারে চলে গেছেন তাঁরা আমাদের ঐতিহ্য , আমাদের গর্ব এবং আমাদের আত্মপরিচয়ের শ্লাঘাবোধ কিন্তু এখনও যারা আছেন, যাদের দেওয়ার অনেক কিছু আছে যারা আমাদের বর্তমান এবং অবশ্যই আমাদের আশ্রয়, সুব্রত (শম্ভু) তাঁদেরই একজন অগ্রণী প্রতিনিধি।
‘আমি মদন বলছি’ নাটকের মদন চরিত্রে বা মাইকেল মধুসূদন চরিত্রে সুব্রত রায়ের একক অভিনয় সহজে ভোলা যাবে না ৷ সমগ্র মঞ্চ দাপিয়ে বেরিয়েছিলেন আর হলভর্তি দর্শকের দৃষ্টিকোণ এক সম্মোহনী মন্ত্রে নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন। কী অসাধারণ অভিনয় ! কথাগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই স্মৃতির দরজায় হাতুড়ি পেটালো। গত ১৬ সেপ্টেম্বর সুব্রত রায়ের ফেসবুকের টাইম লাইনে একটা ভিডিও দেখলাম। প্রতিনিয়ত ‘পোস্ট’ করা অজস্র ভিডিওর ভিড়ে হয়তো এই ভিডিওটি হারিয়েই যেত, কেননা গুণগতবিচারে ফেসবুকে বর্জ্য ভিডিওর সংখ্যাই বেশি। হয়তো সুব্রত রায় নামটা দেখেই চোখ স্থির হল, চঞ্চল মন শান্ত হল আর হাতের আঙুল থেমে গেল। সাধারণত যখন আমরা ফেসবুকে বিচরণ করি তখন একের পর এক পোস্ট নিমেষে পেরিয়ে যাই কখনো বা ‘লাইক’ দিই বা ‘আর আই পি’ অথবা কোনও হালকা মন্তব্য লিখি।
সুব্রত রায়ের ১৫মিনিট ৪৮ সেকেন্ডের ভিডিও কৌতূহল নিয়ে দেখা শুরু করলাম, এই ভিডিও ইতিমধ্যে ১৪৫ জন নিজেদের টাইম লাইনে শেয়ার করেছেন, ১২ হাজার দর্শক দেখেছেন ১৮৯ জন প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন আর ৩৪৮ জন নিজেদের ভালোলাগা জানিয়েছেন। সাধারণত শিলচরের ক্ষেত্রে কোনও সফল মঞ্চস্থ নাটকের দর্শক তিন থেকে চারশত হয়, সেই হিসেবে প্রায় চল্লিশ গুণ অর্থাৎ চল্লিশবার এই নাটক মঞ্চস্থ হলে তবেই এত দর্শক নাটকটি দেখবেন, যা এক কথায় অসম্ভব। আন্তর্জালিক পরিসরকে বেছে নিয়ে সুব্রত রায় মহাশয় যে আধুনিক মন এবং শৈল্পিক বোধের পরিচয় দিয়েছেন তাতে সুব্রত রায়ের ব্যতিক্রমী শিল্পীসত্তা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাই মান্যতা পায়।
২০২২ এর দ্বিতীয় পর্যায়ের বন্যা কতটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় কতটা মানব সৃষ্ট বিপর্যয় এই নিয়ে যখন তরজা তুঙ্গে তখন সুব্রত রায়ের নিজের রচনায়, পরিকল্পনায় এবং অভিনয়ে ভিন্নমাত্রিক আঙ্গিকে উপস্থাপন করলেন একটি নাটক ‘লাশ’। সংজ্ঞায়িত নাটকের বাইরে এক ভিন্নমাত্রিক নাটক উপস্থাপন করে পরিচালক রুমি রায় এবং অভিনেতা সুব্রত রায় আরও একবার প্রমাণ করলেন যে সত্যিকারের শিল্পী থামতে জানেন না। বঙ্গভবনের প্রেক্ষাগৃহ অনেকদিন থেকেই বন্ধ, জেলা গ্রন্থাগারের মিলয়াতনকেও ভেঙে ফেলা হয়েছে৷ এত প্রতিকূলতার মধ্যেও শিলচরের নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অদম্য জেদের ফসল এই নাটক এক নতুন দিগন্তকে উন্মোচিত করল।
রুমি রায় পরিচালিত এই নাটক আসলে একটি সময়ের দলিল, দুঃসময়ের দলিল বলাটাই মানানসই। এক গ্রাম্য মানুষের প্রতিনিধি মদন চরিত্রের মুখ দিয়ে সুব্রত বাবু সেইসব কথা বললেন যা আমাদের সকলের মনের কথা, সেই বেদনাকেই ব্যক্ত করলেন যে বেদনায় আমাদের প্রত্যেকের বুকের পাঁজর ভেঙ্গে খান খান হয়েছে, সেই সব প্রশ্নকেই মদন তুলে ধরেছেন যা আমাদের প্রত্যেকের প্রশ্ন সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে, ঈশ্বরের কাছে। সব কথা, সব বেদনা, সব প্রশ্নকেই অকপটে মনে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না রেখে নির্ভয়ে তুলে ধরেছেন। মধ্যবিত্তের অসহায়তার পাশাপাশি মধ্যবিত্তের উন্নাসিকতা আবার দুর্দিনে জেগে ওঠা মধ্যবিত্তের সংবেদনশীলতা সবকিছুকেই তিনি ১৫ মিনিটের মধ্যে সজোরে নাড়িয়ে দিয়েছেন।
অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা, শুধু মুখের অভিব্যক্তি ও স্বরক্ষেপণের ওঠানামায় আলোড়িত দর্শক মদন চরিত্রের ভিতরেই ঢুকে গেছেন। জনপ্রতিনিধি , প্রশাসনের আধিকারিক এমনকি জেলাশাসকের আচরণ নিয়ে কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, পাশাপাশি যারা পাড়ায় রকে বসে আড্ডা দেয় এই দুর্দিনে তাঁদের অন্তরে জ্বলে ওঠা মানবিকতার প্রদীপের কথা। বেতুকান্দির বাঁধ কেটে নেওয়ার আষাঢ়ে গপ্পো শোনানোর পাশাপাশি মেরামতের ক্ষেত্রে গাফিলতির জন্য জেলা প্রশাসনকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। যে সব মেধাবী ছাত্ররা চিরকাল সমাজ সংসার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে পড়াশোনা করে ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে দুর্দিনে তাঁদের অনেকেই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বেশ কয়েকটি নাটকীয় ক্ল্যাইমেক্সের জন্ম দিয়েছেন, যেমন একটি ক্যানসার রোগাক্রান্ত যুবতীর সাহায্যে এগিয়ে আসা এক ত্রাণকর্মীর সফল প্রয়াস অথবা মায়ের মৃতদেহ সৎকার করতে না পারার তীব্র মানসিক কষ্টে লেখা এক অসহায় ছেলের চিঠি।
সুদীপ্ত চক্রবর্তীর পরিকল্পনায় আবহ সঙ্গীতের প্রশংসা করতেই হয়, তিনি কোনও খামতি রাখেননি। সুব্রত রায়ের পরিবেশনায় উপস্থাপিত এই নাটক যে বিকল্প পরিসর খুলে দিল আগামীতে এই পথেই আরও অনেক বড় প্রযোজনা দেখতে পাব বলেই বিশ্বাস করি।